- বই : জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস
- লেখক : ড. আলী মুহাম্মদ আস-সাল্লাবী
- প্রকাশনী : কালান্তর প্রকাশনী
- বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- পৃষ্ঠা : 864, কভার : হার্ড কভার
এই সাম্রাজ্য দুজন মহান সুলতান পরিচালনা করেছেন; সুলতান ইমাদুদ্দিন জিনকি আর সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি। উল্লেখ্য, জিনকি শব্দটাকে বাংলাদেশের উপন্যাসগুলোতে জঙ্গি লেখা হতো।
এই সাম্রাজ্য জন্ম দিয়েছে হাজার হাজার বীরকে। শতশত আমির, কমান্ডারেরও জন্ম দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে হাজার হাজার গবেষক, আলিম, বুজুর্গ, ফকিহ আর মুহাদ্দিসকে।
খিলাফতের পতাকা যখন পুরো পৃথিবীকে আলোকিত ও আলোড়িত করে যাচ্ছিল, ইউরোপীয়রা তখন ক্রুসেডের নামে বিশ্বমানবতার ওপর ধ্বংসযজ্ঞের মহড়া চালায়; এরই মোকাবিলায় উম্মাহ জেগে ওঠে, কালিমার পতাকা হাতে ঘুরে দাঁড়ায়, জিহাদি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দখলদার শত্রুর শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দেয়।
ক্রুসেডবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের বাগডোর হাতে নেন ইমামুদ্দিন জিনকি, নুরুদ্দিন জিনকি ও সালাহুদ্দিন আইয়ুবি; সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের কিংবদন্তি—আবদুল কাদির জিলানি, ইবনু আসাকির আর ইবনু আসরুন; তাঁদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জিহাদি আন্দোলন, সুফি আন্দোলন, বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম ও উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে জিনকিরা ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করেন। ফলে জিনকিদের ইতিহাস হয়ে ওঠে ক্রুসেডের ইতিহাস।
ক্রুসেডের ইতিহাস বুঝতে হলে জিনকিদের উত্থান, নেতৃত্ব ও শাসনকে বুঝতে হবে; বুঝতে হবে জিহাদি চেতনায় জিনকিদের দুর্নিবার ছুটে চলার ফল-প্রতিক্রিয়া। বিশুদ্ধ, সাবলীল আর প্রামাণ্যে মোদিত করে ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে হাজির হয়েছেন বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি। কালান্তরের অনুবাদ উপস্থাপনায় পড়ুন জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বাংলাভাষী পাঠকের কাছে এতকাল যা ছিল প্রায় অজানা।
এই সাম্রাজ্যের মহান সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি তাঁর আদর্শে আদর্শিত করে জন্ম দিয়ে গেছেন বায়তুল মাকদিস-বিজেতা মহান বীর সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবিকে।
গ্রন্থটিতে পুরো সাম্রাজ্যের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে সুলতান ইমাদুদ্দিন ও নুরুদ্দিন জিনকির পুরো জীবন ও শাসনকার অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় জিনকি সাম্রাজ্য বা এই দুই মহান সুলতানের একমাত্র জীবনীগ্রন্থ ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি রচিত কালান্তর প্রকাশিত ‘জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস’। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এটা ক্রুসেড বিশ্বকোষ সিরিজের দ্বিতীয় সিরিজ।
এ বইটি আপনি না পড়লে ক্রুসেডারদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এ ছাড়া আরও কতকিছু অজানা থেকে যাবে; অথচ এগুলো জানা সচেতন মুসলিমদের জন্য কর্তব্য।
জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস - ড. আলী মুহাম্মদ আস-সাল্লাবী | Jinki Samrajjer Itihas By Dr. Ali Muhammad As-Sallabi বইটি অনেক দিন স্টকে ছিল না। আজকে স্টকে এসেছে। আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন। মূল্য আগেরটাই বহাল আছে।
ভূমিকা
সকল প্রশংসা আল্লাহর। আমরা তাঁর কাছে সাহায্যপ্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি হিদায়াত ও মাগফিরাত। আশ্রয় চাই তাঁর কাছেই আত্মার প্রবঞ্চনা ও মন্দকাজের অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, কেউ তাকে বিপথগামী করতে পারে না; আর যাকে তিনি বিপথগামী করেন, তাকে কেউ সুপথে আনতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এক আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, নেই তাঁর কোনো অংশীদারও। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো, তাহলে তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করে দেবেন, ক্ষমা করে দেবেন তোমাদের পাপরাশি। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে। [সুরা আহজাব : ৭০-৭১
হে আল্লাহ, প্রশংসা করছি যতক্ষণ-না তুমি সন্তুষ্ট হচ্ছ। প্রশংসা তোমার তুমি সন্তুষ্ট হলেও। প্রশংসা করছি তোমার সন্তুষ্টিলাভের পরও।
এ গ্রন্থটি রাসুল সাঃ -এর জীবনী, খিলাফতে রাশিদার যুগ, উমাইয়া ও সেলজুক সালতানাতের বিবরণীগ্রন্থসমূহের সম্প্রসারিত অংশ। এ সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহের মধ্যে সিরাতুন নবি [বিশুদ্ধ ঘটনার আলোকে বিশ্লেষণধর্মী নবিজীবনী] আবু বকর সিদ্দিক, উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবনু আফফান, আলি ইবনু আবি তালিব, হাসান ইবনু আলি রা. প্রকাশিত হয়েছে। আরও প্রকাশের আলো দেখছে উমাইয়া খিলাফতের ইতিহাস, মুআবিয়া ইবনু আবি সুফিয়ান, উমর ইবনু আবদুল আজিজ, সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাস, উসমানি খিলাফতের ইতিহাস, মুরাবিত ও মুওয়াহহিদ সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ফাতিমি-উবায়দি সাম্রাজ্যের ইতিহাস, সানুসি আন্দোলনের সুফল ও কুরআনুল কারিমের আলোকে বিজয় ও সাহায্যপ্রাপ্তির রহস্য।
• সাল্লাবি রচিত উল্লিখিত প্রায় সকল গ্রন্থ কালান্তর প্রকাশনী থেকে বিশুদ্ধ ভাষায় অনুদিত ও সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। – সম্পাদক।
জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড) ১৭
আমি এর নাম রেখেছি, জিনকি সাম্রাজ্যের ইতিহাস [বাতিনি ফিতনা ও ক্রুসেড আগ্রাসনের প্রতিরোধে নুরুদ্দিন মাহমুদ শহিদের নেতৃত্বে ইসলামি সাফল্যের ইতিবৃত্ত], যা উম্মাহ ও ক্রুসেডের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আল্লাহর দরবারে তাঁর সুন্দর নামসমূহ ও গুণের অসিলায় প্রার্থনা করছি, তিনি যেন গ্রন্থটির সুন্দর সমাপ্তির তাওফিক দান করেন এবং এটি যেন হয় একান্ত তাঁর সন্তুষ্টি কামনায়। প্রতিটি গ্রন্থই যেন হয় বরকতময় ও গ্রহণযোগ্য। আমাদের তাওফিক দিন একনিষ্ঠভাবে তাঁর সন্তুষ্টি কামনার। আর তিনি আমাদের কাঙ্ক্ষিত ইতিহাস-বিশ্বকোষ সম্পন্ন করার তাওফিক দিন।
গ্রন্থটিতে আলোচনা করা হয়েছে জিনকিদের ইতিহাস। তাদের বংশধারা, তাঁদের দাদা আক সুনকুরের আলোচনা, সুলতান মালিক শাহের দরবারে তাঁর অবস্থান, হালাবের (আলেপ্পো) অভ্যন্তরীণ ও বাহিরের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব ও সেখানের শাসক হিসেবে নিযুক্তির বিবরণ। আলোচনা করা হয়েছে ইমাদুদ্দিন জিনকির বেড়ে ওঠার কথা। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের উপাখ্যান ও মসুলের আমির হিসেবে তাঁর নিযুক্তির পেছনে বাহাউদ্দিন শাহরাজুরির ভূমিকা। তুলে ধরা হয়েছে বীরত্ব, প্রভাব, কূটনীতি, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, উপযুক্ত লোক নির্বাচনে তাঁর দক্ষতা, বন্ধুদের প্রতি বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইবাদত, ব্যক্তিত্বসহ তাঁর গুণাবলির নানাবিধ বিবরণ।
আলোচনা করা হয়েছে তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কৌশল, প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যবস্থাপনার বিবরণ নিয়ে। আব্বাসি খিলাফত ও সেলজুক সালতানাতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, শামের উত্তরাঞ্চল ও জাজিরার দিকে তাঁর অগ্রযাত্রা, তিকরিতের শাসকগোষ্ঠী বনু আইয়ুবের মতো কুর্দিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, কুর্দি হামিদিয়া, আকারিয়া, মিহরানিয়া ও বাশনাবিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। তুলে ধরা হয়েছে দিয়ারু বকরের স্থানীয় শাসকদের সঙ্গে তাঁর আচরণ।
পারস্পরিক বোঝাপড়া বা অবরোধ আরোপ কিংবা রাজনৈতিকভাবে দামেশক দখলের প্রয়াসের বিবরণ। আমি এ গ্রন্থে আরও আলোচনা করেছি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদের উপাখ্যান। তুলে ধরার চেষ্টা করেছি তাঁর আগমনপূর্ব ওই অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থা। ক্রুসেডারদের সঙ্গে তাঁর রাজনীতি, বিভিন্ন কেল্লা ও দুর্গ বিজয়ের বিবরণ।
কুসেডার আগ্রাসনের মোকাবিলায় মুসলিমশক্তিকে এক মঞ্চে আনতে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বিবরণ। আরও উল্লেখ করেছি বাইজেন্টাইন ও ক্রুসেডার অবরোধের মুখোমুখি হওয়া শাইজার সাম্রাজ্যের বনি মুনকিজের পাশে দাঁড়ানোর বাস্তবতা। হানাদারদের মোকাবিলায় তাঁর সাহসী ভূমিকা ও তাদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা মনস্তাত্ত্বিক ও বাহ্যিক কৌশলের বিবরণ; যেভাবে তিনি কৌশলে শামের ক্রুসেডার ও রোমান বাইজেন্টাইন সম্রাটদের দ্বন্দ্বে হাওয়া দিয়েছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে অনন্য সফলতা অর্জন করেছিলেন; ফলে বাইজেন্টাইন সম্রাট শাইজার অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। সকল প্রশংসা আল্লাহর; আর এভাবেই ইমাদুদ্দিন জিনকির সামরিক তৎপরতা সফলতার মুখ দেখে।
বাইজেন্টাইন ও ক্রুসেডারদের মধ্যে সম্পর্কের অধঃপতন ছিল এই অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। ফলে তারা পরবর্তী কয়েক বছর ওই অঞ্চলে জিনকির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এরপর জিনকি তাঁর পরিকল্পিত একক মুসলিমশক্তি গঠনে মনোযোগ দেন, এর দ্বারা ক্রুসেডারদের চূড়ান্ত মোকাবিলা সম্ভব হয়। তখনকার কবিরাও তাঁর শাইজার প্রতিরক্ষা অভিযানের প্রশংসাগাথা রচনা করেছেন, যেমন : কবি ইবনুল কাসিম হামাবি তাঁর কবিতায় বলেন,
হে মহান সম্রাট, আপনার সুদৃঢ় মানসিকতার সামনে সব বাধা ও বিপদ যেন বশ্যতা স্বীকার করে।
আপনি কী দেখেছেন! রোমান কুকুর যখন বুঝেছে, তার ক্ষমতা অচিরেই হস্তচ্যুত হবে,
ফিরিঙ্গিরা আপনার কাছে কী ক্ষমা প্রার্থনা করে; অথচ আপনি তাদের মূলোৎপাটনের অধিপতি,
আপনার তরবারি যখন কারও ওপর ঝলসে উঠে, প্রথমেই সেটি তার মুণ্ডুপাত করে।
মহান আল্লাহর অশেষ দয়া ও অনুগ্রহে জিনকি ক্রুসেডারদের হাত থেকে এডেসা সাম্রাজ্য জয় করতে সক্ষম হন। এই সাম্রাজ্য ক্রুসেডার সেনাপতি প্রথম বল্ডউইনের হাত ধরে ৪৯১ হিজরি—১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর মুসলমানদের হাতে এটি বিজয় হয় ৫৩৯ হিজরিতে। ইমাদুদ্দিন জিনকির এডেসা বিজয়ের পেছনে বেশ কিছু নিয়ামক ভূমিকা রাখে; তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিল তাঁর সময়ে জিহাদের প্রাণসঞ্চার এবং এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের অভিজ্ঞতা অর্জন। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাসমূহ প্রমাণ করে এডেসা সাম্রাজ্যই ক্রুসেডারদের অধিকৃত এমন প্রথম সাম্রাজ্য হওয়ার সম্ভাবনাময় ছিল, যা মুসলমানদের হাতে বিজিত হতে পারে। আর মসুলের আমিরদের তরফে পরিচালিত টানা চার দশকের আগ্রাসন এডেসাকে ধীরে ধীরে পতনের দিকে ঠেলে দেয়; সেই বছর যার চূড়ান্ত পতন নিশ্চিত হয়। এর সঙ্গে যোগ করতে হয় জিনকির সামরিক বিচক্ষণতার কথা। তিনি এই ক্রুসেড সাম্রাজ্যে এমন সময়ে হানা দেন, যখন ক্রুসেডাররা তাঁর ব্যাপারে পুরোপুরি নিরুদ্বিগ্ন ছিল। তারা ভেবেছিল হয়তো তিনি তাদের ওপর আক্রমণ করবেন না; আর তখনই
* বর্তমান (তুর্কি) নাম সানলিউরফা (Sanhurta)। আরবি নাম আর রুহা। বর্তমান গ্রিসে এডেসা নামেও প্রাচীন একটা জায়গা আছে। – সম্পাদক।
তিনি সেখানের শাসক দ্বিতীয় জোসেলিনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি চূড়ান্ত আঘাত হেনে শহরটি দখল করে নেন। এভাবেই এই মহান সেনানায়ক উপযুক্ত সময়ে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ইমাদুদ্দিন জিনকি এডেসা বিজয়ের মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ শাসনামলজুড়ে ক্রুসেডারবিরোধী অভিযানগুলোর সেরা সফলতা অর্জন করেন। তাঁর এই বিজয় মুসলমান ও খ্রিষ্টবিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে আনে। যেমন :
১. জিহাদের তৎপরতা ততদিনে শক্তপোক্ত হয়। সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আমির মাওদুদ ইবনু তুনতাকিনসহ জিনকিপূর্ব মুসলিম বীরসেনানীদের সাফল্যগাথাসমূহ বিস্মৃত না হয়ে তাঁরা আরও শক্তিশালী হন— আজ মুসলমানদের হাতে প্রথম কোনো ক্রুসেডার সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে, আজ এডেসার পতন হয়েছে, আগামী দিনে আরও বহু শহরের পতন হবে। বাস্তবে হয়েও ছিল তা-ই। এখন আর তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না; এখন সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
২. মুসলিম ভূখণ্ডে ইসলামবিরোধী ক্রুসেডারশক্তি কখনো স্থায়িত্ব পেতে পারে না। কেননা, সঠিক তাওহিদি চেতনায় বিশ্বাসী প্রজন্ম কখনো এমন বহিরাগত রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে বরদাশত করে না। আর উত্তর-ইরাকে এভাবেই এই মনোভাবের বিস্তার ঘটতে থাকে। আর এডেসা সাম্রাজ্যকে এশিয়া মাইনরের সেলজুক সাম্রাজ্য ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্রুসেডীয় অস্তিত্বের বিভেদের দেয়াল হিসেবে গণ্য করা হয়নি; এটি পারস্যের জন্যও বাধার প্রাচীর ছিল না।
৩. এডেসা বিজয়ের মাধ্যমে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তির উত্থানের যে নমুনা দৃশ্যমান হয়, পশ্চিমারা এই রাজনৈতিক উত্থান মেনে নিতে পারছিল না। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ও মসুলের নেতৃত্বের প্রস্তুতিদৃষ্টে সেখানে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করে; এর জন্য ৫৪২ হিজরিতে দ্বিতীয় ক্রুসেডের সূচনা হয়, যা ছিল বাস্তবে পশ্চিমাদের এডেসা পরাজয়ের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। আর এই ঘটনাচক্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ইসলামি যুদ্ধের মহানায়করা কীভাবে পরাশক্তির মোকাবিলা করেছিলেন। তাঁরা শুধু সীমিত ক্ষমতার অধিকারী স্থানীয় শক্তি হয়ে টিকে থাকার প্রয়াস চালাননি; বরং বৈশ্বিক শক্তির অংশ হিসেবে নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করে ইতিহাসে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেন। সে সময়ের প্রখ্যাত কবিরাও জিনকির এডেসা বিজয়ের বিজয়গাথা রচনা করেছেন।
বস্তুত এডেসা বিজয় ছিল পরবর্তী বিজয়ের সদর দরজা। তারপর ইমাদুদ্দিন জিনকির জন্য তাঁর পরিকল্পনামাফিক এই সাম্রাজ্যের অধীন কেল্লাগুলো হস্তগত করা তেমন কষ্টসাধ্য ছিল না। তিনি ক্রুসেডারদের দুর্বলতার সুযোগ নেন; আর নিজের পরিকল্পনার বহুলাংশ বাস্তবায়নে সক্ষম হন। তিনি নিজেকে ইসলামের ইতিহাসে একজন ঝানু রাজনীতিবিদ, শক্তিশালী সেনানায়ক ও ন্যায়পরায়ণ মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হন। ক্রুসেডারদের পক্ষ থেকে মুসলিমবিশ্বের প্রতি ধেয়ে আসা বিপদের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনে সক্ষম হন। ফলে নিজের বিচক্ষণতায় ইতিহাসের গতি মুসলমানদের অনুকূলে প্রবহমান করতে পেরেছেন। এটি সম্ভব হয়েছিল মুসলিমবিশ্বকে দ্বিধাবিভক্তি থেকে উদ্ধার করে ঐক্যবদ্ধ শক্তিরূপে গড়ে তোলার মাধ্যমে। একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে তাঁর পরিকল্পনার যথাসাধ্য বাস্তবায়ন করেন। তাঁর এসব পরিকল্পনার মধ্যে বিশেষ ছিল একক মুসলিমশক্তি গঠন ও ক্রুসেডারদের ওপর আক্রমণ। ইমাদুদ্দিন জিনকিকে প্রথম এমন সেলজুক সেনাপতি গণ্য করা হয়, যিনি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধীনে মুসলিমশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেন; তিনি বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে ক্রুসেডারদের বাড়ন্ত শক্তি রুখে দিতে সক্ষম হন। অথচ তাঁর পূর্ববর্তীদের অভিযানগুলো এই আগ্রাসন থামাতে পারেনি। বিশেষত ৫০২–৫০৭ হিজরিতে মাওদুদ ইবনু তুনতাকিনের সময়ে এবং ৫১৮ – ৫২০ হিজরিতে ইলগাজি ও বালাক আরতুকিদের আমলে পরিচালিত অভিযানগুলো।
ইমাদুদ্দিন জিনকি তাঁর পরবর্তীদের জন্য স্বাধীনতা-সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করে যান। তাঁর পরবর্তী সময়ে নুরুদ্দিন মাহমুদ ও সালাহুদ্দিন আইয়ুবি তাঁর দেওয়া রূপরেখার বাস্তবায়ন করেন। ইমাদুদ্দিন জিনকির তিরোধানের পর নেতৃত্বের আসনে আসীন হন তাঁরই পুত্র মহান সম্রাট প্রসিদ্ধ সাহসী শার্দূল নুরুদ্দিন মাহমুদ শহিদ। আমি এ গ্রন্থে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত উল্লেখ করেছি। তুলে ধরেছি তাঁর ভাই সাইফুদ্দিন গাজির সঙ্গে জিনকি পরিবারের উত্তরাধিকার বণ্টনে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিবরণ এবং একক শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ; যার পরিপ্রেক্ষিতে গাজি সাইফুদ্দিন শাসক নিযুক্ত হন মসুলের; আর নুরুদ্দিন মাহমুদ আমির হিসেবে দায়িত্ব নেন হালাবের। বিশদভাবে আলোচনা করেছি নুরুদ্দিন জিনকির ব্যক্তিত্ব, তাঁর দায়িত্বসচেতনতা, ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধারের আকুলতা, আল্লাহর দরবারে হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতি ও ইমানি চেতনার বিবরণ। আর এই সত্যিকারের ইমানি চেতনার ফলে তাঁর চরিত্রে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ছটা প্রতিবিম্ব হয়। তিনি ইসলামের সঠিক অনুভব ও আল্লাহর ইবাদতের বাস্তব ধারণা লালন করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে অসাধারণ বহু গুণ ও উত্তম আদর্শের মিশেল বিশাল সফলতার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছিল; একাগ্রতা, বুদ্ধিমত্তা, দায়িত্বসচেতনতা, বিপদের মুখে অবিচল থাকার প্রবণতা, স্থাপত্য নির্মাণের ঝোঁক, ব্যক্তিগত সামর্থ্য, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রিয়পাত্র হওয়া, শারিরিক সক্ষমতা ও দুনিয়াবিমুখ হওয়ার কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আমি আরও আলোচনা করেছি জিহাদের প্রতি তাঁর আকুলতা ও শাহাদাতের জন্য তীব্র ব্যাকুলতার কথা। ইতিহাসবিদ ইমাদুদ্দিন ইসফাহানি বলেন, আমি একবার সফর মাসে নুরুদ্দিনের দরবারে দামেশক উপস্থিত হই। তাঁর দরবারে তখন আলোচনা হচ্ছিল দামেশকের সুন্দর প্রকৃতি ও মনোরম আবহাওয়া নিয়ে। উপস্থিত সবাই এর প্রশংসা করি ও নিজেদের মুগ্ধতার কথা বলি। নুরুদ্দিন জিনকি তখন বলেন, 'জিহাদের অনুরাগ আমাকে এর মুগ্ধতা ভুলিয়ে দিচ্ছে, তাই আমি এদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না।' যখন তিনি মসুলে প্রবেশ করেন, ২০ দিন পরেই মসুল থেকে বেরিয়ে যান। তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে বলেন, 'আমরা তো জানি আপনি মসুলে থাকতে ভালোবাসেন; অথচ আপনি দ্রুত মসুল ছেড়ে এসেছেন?' উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেখানে আমার মন বিষিয়ে আসছে। যদি আমি তা ছেড়ে না আসি, তাহলে আমার ওপর অবিচার হয়ে যাবে। আর সেখানে থাকলে জিহাদে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়।' তিনি শাহাদাতের প্রতি পরম অনুরাগী ছিলেন। কামনা করতেন পরকালে যেন আল্লাহ তাঁর দেহ হিংস্র প্রাণী ও পাখির পেট থেকে উত্থিত করেন।
গ্রন্থটিতে আমি উল্লেখ করেছি তাঁর ইবাদতে নিমগ্ন থাকার কিছু বিবরণ; তিনি রাতের অধিকাংশ সময় সালাতে প্রভুর সান্নিধ্যে কাটাতেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অত্যন্ত একাগ্রতার সঙ্গে জামাআতে আদায় করতেন। সব ব্যাপারেই আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দুআ করতেন। দানশীলতার জন্যও প্রসিদ্ধ ছিলেন। মসজিদ-মাদরাসা হাসপাতাল নির্মাণ, ইয়াতিম বিধবাদের সাহায্য-সহযোগিতাসহ সামাজিক বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর দান ছিল লোকমুখে প্রসিদ্ধ। সে সময়কার কবি-সাহিত্যিকরা তাঁর এসব অনুদানের প্রশংসাগাথা রচনা করে তাঁকে অমর করে তুলেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....