বলছিলাম বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও তার সহধর্মিণী সরলার কথা। আজ আব্দুল করিমের প্রয়াণ দিবস। কিছু জানা ঘটনা বলে তাকে আজ স্বরণ করবো।
আব্দুল করিমের সহধর্মিণী সরলা যেদিন মারা গেলেন সেদিনও কাছে কিনারে ছিলেন না শাহ আব্দুল করিম। তিনি তখন পড়ে আছেন, কোনো গানের আসরে। যখন জানলেন তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল তার! কে জানে। যদিও এক জীবনে তিনি সরলার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেন নি কখনো আর। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যখন দেখলেন তিনি গান বাজনা করেন দেখে সরলার লাশ জানাজার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, বাউলের স্ত্রীর আবার কিসের জানাজা, বাউলার স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নেই। আব্দুল করিম নিজেই নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় নিজের স্ত্রীর জানাজা পড়ালেন। মুঘল সম্রাট শাহাজাহান মমতাজের জন্য সূদূর ইতালি থেকে সাদা মার্বেল এনে ঈশা আফিন্দিকে দিয়ে বানিয়েছিলেন তাজমহল। শাহ আব্দুল করিম ধন-দৌলতে সেই বাদশার ধারে কাছেও না, কিন্তু মনের মধ্যে পুষে রাখা যে প্রেম সেটা যে সত্য। করিম নিজ হাতে বানিয়েছেন সরলামহল, যে ঘরে শুয়ে আছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা। এখানে হয়-তো কোনো কোনো দিন নিজেই আপন মনে গান গেয়ে উঠতেন, কেনো পিরীতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি....
একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা অনুষ্ঠানের ডাক পান শাহ আব্দুল করিম। তার সাক্ষাৎকার নেয়া হলো। কিন্তু ফিরবার সময় হুমায়ূন আহমেদের সাথে সৌজন্য দেখা হলো না তার। এই নিয়ে হয়ত মনের কোথাও আক্ষেপ জমেছিল আব্দুল করিমের। এই ঘটনা প্রসঙ্গে আব্দুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল বলেন,“বিদায়ের সময় ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, তিনি নিজে একবার বাবার সঙ্গে দেখাও করলেন না।”
অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে শাহ আব্দুল করিমের গান বেশ পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, “এই লোকটি প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের মিশ্রণ। তাঁর গানে সুরের যে ব্যবহার, তা খুবই বৈচিত্র্যময়।” তাছাড়া, বাংলাদেশ টেলিভিশনে শাহ আব্দুল করিমের গীতিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান ছিল। কারণ যে প্রোগ্রামটি তিনি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, সেটি জমা দেয়ার পর জানতে পারেন যেহেতু শাহ আব্দুল করিম বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার নন, তাই বিটিভি প্রোগ্রামটি প্রচার করতে চাচ্ছে না। হুমায়ূন আহমেদ তাই এই শিল্পীকে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার করে নেয়ার পরামর্শ দেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকে তাকে পদক দিয়ে নাটক করেছে কিছু সুশীল সংগঠন। সেই প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেন,"পদক আনতে শহরে গেছি, আইবার সময় পকেটে টাকা নাই। এই পদক-টদকের কোনো দাম নাই। সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না।”
একবার তিনি রেডিয়োর একটা চেক ভাঙ্গাতে গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। আব্দুল করিমের পরনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি। তাকে দেখে ব্যাংকের কেউ কি ভেবেছে কে জানে! কিন্তু আব্দুল করিম ভীষণ অপমানিত বোধ করেছেন। তিনি বিলাতে গান গাইতে গিয়েছেন। সেখানে দেখেছেন, মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু নিজের দেশে দেখলেন এখানে মানুষের মর্যাদা পদ পদবিতে, পোষাকে, চেহারায়।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া তো কি হয়েছে, আমি কি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গিতে নাহয় তিনটা তালি বসানো, কিন্তু আমি তো ট্যাক্স ফাঁকি দেই নাই কখনো। তাহলে এত ব্যবধান, এত বৈষম্য কেন? মানুষ তো মানুষের কাছে যায়। আমি তো কোনো বন্যপশু হয়ে যাই নি। বন্যপশুরও অনেক দাম আছে, এদেশে মানুষের কোনো দাম নেই, ইজ্জত নেই। আব্দুল করিমের গানের কথা অনেকে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়। রিমিক্স করেছেন, নিজের মতো গেয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। অথচ, কেউ কখনো আব্দুল করিমের কাছে অনুমতি নিতে আসেন নি। কমার্শিয়াল প্রয়োজনে ব্যবহার করা আব্দুল করিমের গানের জন্য তিনি নিজে কতটুকু সম্মানিত হয়েছেন? এমন অনেক গান আছে, মানুষ শুনেছে, মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু জানেও না সেসব শাহ আব্দুল করিমের গান।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভাটি অঞ্চলের মানুষেরা জানতে পারলো, তাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় বাউল শাহ আব্দুল করিম আর নেই। চিরনিদ্রায় ডুবে গেছেন খানিক আগে। শোকের ছায়া নেমে আসলো চারধারে। চোখের জলে ভাটি অঞ্চলের মাটিতে আজ রচিত হচ্ছে শোকগাঁথা।
আব্দুল করিমের লাশ রাখা হয়েছিল শহীদ মিনারে। সেখানে অগণিত মানুষ এসেছেন মানুষটাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি গানের মানুষ। তাই তার শেষ শ্রদ্ধায় তাকে তার রচিত গান দিয়েই অশ্রুজলে বিদায় দেয়া হলো।
শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম প্রিয় দুই শিষ্য আবদুর রহমান ও রণেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাউলেরা শহিদ বেদিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালি গলায় গাইতে শুরু করলেন, কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…
বেলা দেড়টা। ধলগ্রামের উদ্দেশ্যে একসাথে বেড়িয়েছে অনেকগুলো নৌকার বহর। একটি নৌকা অবশ্য বেশ বড়ো। আলাদা করে চোখে পড়ছে। সেই নাওয়ের ছাদের অনেক ফুলের মালা। যেন একটা ফুলের কুঞ্জ। এই নৌকায় সওয়ারি হয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। নৌকা যাচ্ছে উজানধল গ্রামের দিকে। নৌকার বহরের যাত্রা গ্রামের মসজিদের দিকে। কথা আছে সেখানে হবে, এই বাউলের তৃতীয় জানাজা।
মানুষটা কখনো দাম পায় নি। কীভাবে অভাবে দিনযাপন করছে। আজ তার গানগুলো গেয়ে অনেকেই খ্যাতি অর্জন করেছে। গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ভোগবিলাসের জীবনও কাটাচ্ছে। গানের সুর ও শব্দ পরিবর্তন করে আহাম্মককের মতো চিল্লাইয়া ফাল্লাইয়া যাচ্ছে। তবে একজন আব্দুল করিম বাংলা সঙ্গীত অঙ্গনে একাধারে গীতিকার, সুরকার, রূপকার ও গায়ক হয়ে রেখে গেছে তা মহামূল্যবান হিরা। মাটির গানের সুর কানে বাজলেই বেজে ওঠে বাউল আব্দুল করিম বলে গো.....এর সাথে কোনো বাক্য। আব্দুল করিমের শুধু জনপ্রিয় গানের তালিকা করতে গেলে এমন অসংখ্য পোস্ট লিখে তালিকা করতে হবে। তার প্রয়াণ দিবসে রইলো দোয়া।।
'কিছু তথ্য সংকলিত।' - Writer : Shamim Hossain
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....