কারণ, যে সময়টিতে আমি নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসতটুকু পাচ্ছি না, সামনে পড়ে আছে কাজের পাহাড়, এমন মাথাপাগল ব্যস্ত সময়েও যে নিজের সামান্য একটু উপস্থিতি দিয়ে আমার মন মস্তিষ্ক শরীর সব কিছুকে বন্দি করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে, তাকে আমি উৎপাত বলব না তো কী বলব! এই পিচ্চির নাম জুমানা। ছোটভাই আনাসের মেয়ে। বয়স সবে দুই পেরোলো। টুকটুক করে হাঁটে। একা একা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যায় আসে। এ রুমে ও রুমে গিয়ে পর্দার আড়াল হতে একটু করে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। ঠিক একটা প্রজাপতি যেন, উড়ছে ঘরজুড়ে।
ওর সাথে আমার সম্পর্কটার বিশেষ একটা ইতিহাস তৈরী হয়েছে। সে সম্পর্ক সরল রেখায় না গিয়ে এগিয়েছে একটু দ্বন্দ্বপূর্ণভাবে। সেই ব্যাপারটা আগে বলে নিই। ওর বয়স যখন আরো কম ছিল, বোধ করি দেড়, সে সময়টিতে আমাদের মধ্যে কেমন একটু রেষারেষি দেখা দিল। পাত্তা দিত না, আবার পরিত্যাগও করত না। সেই যে 'না দিলা দূরে যাইবার অনুমতি, না দিলা কাছে আসবার অধিকার' কিছুটা এমন।
এ সময়গুলোতে খেয়াল করতাম সে যখন বাবার কোলে থাকে, কী হাশিখুশি! নাকে দাড়িতে ধরে টেনেমেনে খিলখিল! যেই না আমি কাছে গেলাম, হাত বাড়ালাম বুকে নেব, অমনি ঝপাৎ। হাসি বন্ধ করে গম্ভীর মুখে সে কি ভাব তার! চোখে চোখ ফেলে তাকাবে না, মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে পরোক্ষ হয়ে একটু তাকায়। চোখের গতিপথটাও বড় অদ্ভুত! মনে হয় যেন তাকিয়েছে নিজেরই বাহু বা বাবার হাতের দিকে। আমাকে দেখছেই না। তা সে তাকাতেই পারে। যার যার স্বাধীনতা।
এখানে অনুযোগ করার আমি কে? কিন্তু সমস্যা হলো এভাবে তো মানুষ তাকায় মুহুর্তের জন্য শুধু, দেখার প্রয়োজনটুকু শেষ হলেই চোখ ফিরিয়ে নেয়; কিন্তু এই পিচ্চি তো সেটা করে না। চোখ না সরিয়ে তাকিয়েই থাকে। এটা তো অন্যায়! তুলতুলে এই ছোট্ট প্রজাপতির আত্মগরীমার সুষমা, পরিত্যাগের অভিমান, আবার চোখের কোণ দিয়ে মায়ার তীরে বিদ্ধ করে রাখা, মা গো, আমি যে মরে যাই। আনন্দে দিশেহারা হয়ে গালটা একটু করে টেনে দিই, তুলতুলে পায়ের তলায় কাতুকুতু, আঙুলের ডগায় একটু আদুরে কামড়। চুপচাপ সবকিছু উপভোগ করে। চেহারাটি ঝলমল করে আনন্দে, কিন্তু তা বুঝতে দিবে না। বানোয়াট এক গাম্ভীর্য দিয়ে সব কিছু ঢেকে রাখবে, যেন কী এক অভিমান; মেঘের আড়ালে পড়া সুর্যটা; সেখান হতে অদ্ভুত এক আলোকচ্ছটা ছড়িয়েছে আকাশপাড়ে, চেহারায়, চোখের তলে, কপালের সূক্ষ্ম আনন্দরেখায়।
এমন আদুরে পরিত্যাগের পরও আমি বার বার যাই তার কাছে। প্রথম যেদিন মুখটা কালো করে নিমরাজি হয়ে আমার কোলে এলো, সত্যি বলছি আনন্দে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন।
এরপর একদিন মাস দুয়েকের জন্য উধাও। নাই তো নাই। দূরে থেকে আমার মন পুড়ে। তারপর এক দুপুরে ঘরে ফিরে দেখি আচানক রাঙাপরী। টুকটুক করে হাঁটছে। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমার অজান্তে তলে তলে এদ্দূর! হাঁটতে শিখে গেলি, জানালে না পর্যন্ত। এই সময়টার পর হতেই খুব দ্রুত উন্নতি ঘটে আমাদের সম্পর্কের।
এ ক'দিন হলো মাদরাসা ছুটি৷ আমি সারাদিন রুমে বসে লেখালেখির কাজ করি। ছুটি শেষ হওয়ার আগে আগে কাজটা গুছিয়ে আনতে হবে। মোবাইলটা প্রায়ই ফ্লাইট মোডে দিয়ে দিই। যেন কেউ খুঁজে না পায়। যেন পরে অজুহাত দিয়ে বলতে পারি ব্যস্ত ছিলাম, তাই এই কাজ করেছি। কিন্তু এই পিচ্চি আমার সেসব বুঝবে কেন? ও চামচটা বাটিটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে আমার দরজায় এসে সে চামচ দিয়ে বাড়ি দেয়: চাচ্চু! চাচ্চু! বাংলা ধ্বনিতে অনুযায়ী চাচ্চু শব্দের উচ্চারণটা অতোটা জলশক্তমক্ত কিছু নয়। কিন্তু সে বড়দের সাপেক্ষে। না হয় তিনটা 'চ' যুক্তভাবে উচ্চারণ করাটা একটা শিশুর জন্য কিছুটা আয়াস সাধ্যই বটে। তাছাড়া চ কঠিন না হলেও ল বা ম এর মতো কোমলও তো নয়। ফলে খুব কষ্ট করে অক্ষর তিনটি সে রাঙামুখে ফুটিয়ে তুলে, নিজস্ব এক অদ্ভুত কায়দায়। আওয়াজ ফুটে কি ফুটে না। শিশুদের কথায় শব্দ উচ্চারণে এই এক মায়া। আমি দরোজা খুলে দিই। পাত্তা নাদেওয়ার সেই বদভ্যাসটা এখনো আছে তার। রুমে ঢুকে স্বাধীনমতো এখানে ওখানে যায়। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। আমি ডাক দিয়ে এটাসেটা জিজ্ঞেস করি৷ জবাব দেয় না। মাঝে মাঝে একটু তাকিয়ে সামান্য হাসে, তারপরই হাসি বন্ধ করে পা নাচিয়ে নাচিয়ে নিজস্ব হণ্টনে মগ্ন তিনি। হাসিটা দিয়েছেন এমনভাবে যেন আমি খুব শিশু এক, অনর্থক প্রশ্ন করে বিরক্ত করছি, আর তিনি দয়া দেখিয়ে সে বিরক্তিটা প্রকাশ করেননি৷ সামান্য হাসি দিয়ে করুণা করেছেন এবং শিশুসুলভ সান্ত্বনা দিয়ে বিরক্ত না করতে বলছেন। কিন্তু এমন অপমান আমি সইব কেন? জাপটে ধরে আচ্ছামত পিটুনি দিই। গালে পিঠে থাপ্পর। কিন্তু দুষ্টটা ব্যথা পেয়েও কিলখিল করে হেসে গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ে। কখনো কখনো লম্বা সময় পেরিয়ে যায়, তার দেখা নেই। আমি তখন ডেকে নিয়ে আসি। এমনভাব নিয়ে বের হবেন তিনি, আমি যেন তার সমবয়স্ক এক খেলার সাথী।
উনার বসবাস মূলত দোতলায়। এই একটু আগে নীচতলার কোণার রুমটাতে খুটখুট করে কী করছেন যেন। নিশ্চয়ই মহা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে আছেন। ডাক দিয়েই আমি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। কাউকে খুঁজে না পেয়ে বিভ্রান্ত হোক। সহজে ধরা দিব না। আত্মগরীমা তো আমারও আছে। ডাক পেয়ে তিনি তড়িৎ বেরিয়ে এলেন৷ কী তার ভাব! ঘাড়টা একটু বাঁকা করে ঠোঁট দুটো বাম দিকে চেপে রেখেছেন৷ চোখে কিছুটা বিরক্ত ভাব। আমাকে খুঁজতে লাগলেন এমন একটা ভঙ্গি নিয়ে, যেন না পেলেও কোন সমস্যা নেই। কিছুই আসবে না তাতে, যাবেও না। এমন বেপরোয়া যে, তার থেকে বেশি সময় লুকিয়ে থাকা মুশকিল আছে।
উনি বেশ জেদীও বটে। প্রায়ই মারধোর করেন। কী বাবা, কী আমি। কাউকে পরোয়া নেই৷ মেজাজ খারাপ থাকলে উনাকে কোলে নেওয়া চলবে না, আবার নীচেও রাখা যাবে না৷ ভীষন এক দ্বান্দ্বিক আকাঙ্ক্ষার ভিতর পুরো পৃথিবীকে অচল করে দিয়ে গাল ফুলিয়ে তিনি বসে থাকবেন। তার বিরক্ত হয়ে 'যা' বলাটা এতো সুন্দর! কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর বুঝি 'না' বলাটাই। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ এই 'না'টা তিনি প্রথমেই বলবেন না। শুরু করবেন কিছুটা বিরক্তিসূচক ক্রন্দন ধ্বনি দিয়ে। ধ্বনিটা পরিমিত পরিমাণে একটু সময় ধরে রেখে তারপর একটু ঢেউ তুলে এমন তুলতুলে একটা 'না' যে বলবেন, আহা, এর মধুরতাটি আমি কীভাবে বুঝাই?
আমি তার সুন্দর এক ঘোড়া যেন। পিঠে চড়বেন, ঘাড়ে উঠবেন। মহাত্মনকে নিয়ে আমার ঘুরতে হবে ঘরে বাইরে। আর আমার দুটো হাত যেন তার মজার দোলনা এক। খুব ধীরে ঢেউ তুলে শুন্যে দোল খাওয়াতে হবে। কথা না শুনলে নাকেমুখে থাপ্পড়। যে শাসন করে সে তো আদরও করে, এমনটিই তো শুনে এসেছি আজীবন, দেখেও এসেছি অভিজ্ঞতায়; কিন্তু তিনি এই মূলনীতি সবসময় মানতে নারাজ। একটা চুমু আদায় করতে কী যে কসরত করতে হয় আমার।
মাঝে মাঝে ভাবি: সব স্বর্গীয় শিশুগণ একদিন বড় হবে, আর আমরা বড় হতে হতে মরে যাব। ওর নিশ্চয়ই মনে পড়বে এইসব স্মৃতির প্রহর। আমার কবরে হয়তো ঘাস উঠবে সেদিন। ভাঙা কবরে শুয়ে থাকব, কে জানে কী অবস্থায়। কোন কোন দিন ওর হয়তো মন খারাপ হবে খুব। তন্ময় হয়ে ভাববে: 'আহা, চাচ্চুটা কী পাগলা ছিল! দিশেহারা হতো মমতায়, ভালোবাসায়।' হৃদয়ের এই যে উত্তাপ, এই যে মন খারাপ আর বিষণ্নতা, সেখান থেকে হয়তো একটা ফরিয়াদ জাগবে আল্লাহর প্রতি, অস্ফুট স্বরে। আমার পাওনা তো এটুকুই।
মামনি, ছোট্ট জুমানাটা! বড় হয়ে এ লেখা কি পাবে তুমি? জানি না। যদি পাও, আর আমি না থাকি তখন, আমি খুব চাইব পড়ার পর তোমার মনটা একটু বিষণ্ন হোক।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....