প্যাট্রিক রথফাসের লেখনী এবং দ্য কিং কিলার ক্রনিকল | The Kingkiller Chronicle


অনেকদিন ধরেই ভীষণ প্রিয় এই সিরিজটা এবং প্রিয় এই লেখকের লেখা নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু শুধু একটা বই পর্যালোচনা দিলে প্যাট্রিক রথফাসের অবমাননা করা হয়। এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত হলেও কিং কিলার ক্রনিকল শুধু একটা ফ্যান্টাসি সিরিজই না, বরং আরো বেশি কিছু।
থ্রিলার এবং ফ্যান্টাসিকে সাহিত্যের জাতেই ফেলতে চান না অনেক নাক উঁচু “বোদ্ধা” (আমার ভাষায় বুদ্ধু!) পণ্ডিত। এমনকি সেই সব তা বড় তা বড় তথাকথিত পন্ডিতদেরকেও রথফাসের লেখা পড়ে বলতেই হবে এটা সাহিত্যের মানদন্ডে অনেক উঁচু মাপের কাজ। ব্যক্তিগতভাবে আমি নেইম অব দ্য উইন্ড এবং ওয়াইজ ম্যান’স ফিয়ারকে আলেকজান্ডার দ্যুমা কিংবা লিও টলস্টয়ের সাহিত্যকর্মের চেয়ে কোন অংশে কম মনে করি না। এক কথায় বললে বলতে হয় অন্যান্য বেশীরভাগ লেখক যখন শব্দ ব্যবহার করে একটা গল্প বলেন, প্যাট্রিক রথফাস তখন শব্দকেই গল্পের অংশ করে তোলেন। কী বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন যাহ! এমনও আবার হয় নাকি? প্লীজ,আমার উপরে ভরসা রাখুন। যাঁরা কিং কিলার ক্রনিকল পড়েননি তাঁরা তো বটেই, যাঁরা পড়েছেন তাঁদেরকেও বলছি – চলুক আরেক দফা ঘুরে আসি প্যাট্রিক রথফাসের মোহময়ী ভাষার জগৎ এবং তাঁর শব্দের কারিকুরির মাঝে। কী বলেন?
চলুন শুরু করি।
প্রথমেই একটা কথা বলে নিই। আমি কিন্তু কিং কিলার ক্রনিকলের বা দুটো বইয়ের কোনটার রিভিউ দেবো না আজকে। আজকে শুধু প্যাট্রিক রথফাসের যাদুকরী লেখনীর কথা আলোচনা করবো।
কিং কিলার ক্রনিকলের এ পর্যন্ত প্রকাশিত দুটো বইয়েরই উপক্রমনিকা (প্রোলগ) এবং সমাপনী (এপিলোগ) একই নামের। তিন পরতের নিস্তব্ধতা (আ সাইলেন্স অব থ্রি পার্টস)। এক পৃষ্ঠা করে লেখা এই চারটি ক্ষুদ্র অংশ একই রকমের হলেও এদের মধ্যে শব্দ চয়ন আর বাক্য গঠন দিয়ে পাঠকের জন্য অনেক, অ-নে-ক কিছু ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নাম শুনে কী মনে হয়? গভীর রাত্রির কিংবা ভোর হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চরাচরের নীরবতার কথা বলা হয়েছে? হ্যাঁ। শব্দের অনুপস্থিতির কারণে যে নীরবতার সৃষ্টি হয়, সেটা এই নিস্তব্ধতার মাত্র একটা পরত, সবচেয়ে ছোট স্তর, যেটা সবাই চট করে ধরতে পারবে। কিন্তু বাকী দুটি তা নয়। শব্দহীনতার পরের পরত হচ্ছে ভীতির। হ্যাঁ, ভয় থেকে যদি কেউ কোন দুঃসংবাদ নিয়ে কোন আলোচনা করা থেকে বিরত থাকে, কিংবা শংকিত অবস্থায় বিছানায় চুপ করে পড়ে থাকে, তবে সেই নিস্তব্ধতা কেমন বুকের উপরে চেপে বসে থাকে না? সেটা এই নিস্তব্ধতার দ্বিতীয় স্তর। আর সবচেয়ে ভারী, সবচেয়ে গভীর আর সবচেয়ে ছড়ানো নিস্তব্ধতা হচ্ছে একজন মানুষের – এমন একজন মানুষের যে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে! এই নিস্তব্ধতা কিন্তু নৈঃশব্দ নয়, নয় নীরবতাও। মৃত্যু, এবং মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের নির্বাক প্রতীক্ষা হচ্ছে এই নিস্তব্ধতা। আর এখানে কী যে আশ্চর্য একটা উপমা দিয়ে এটাকে বোঝানো হয়েছে ব্যাখ্যা না করে থাকতে পারছিনা।
প্রথম বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার শেষ বাক্য - এটি মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা একজন মানুষের শান্ত সমাহিত, ফুল ঝরা শব্দ (It was the patient, cut-flower sound of a man who is waiting to die.)। কী অদ্ভুত ভাষার প্রয়োগ! নিস্তব্ধতা নিজেই তো মৃত্যুর একটা উপমা। তার পাশাপাশি কাট-ফ্লাওয়ার সাউন্ড? এটার কিন্তু বিশাল একটা ব্যপ্তি আছে। চিন্তা করুন তো পাশ্চাত্য সাহিত্যে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় প্রতীক কী? হ্যাঁ, রিপার এবং তার কাস্তে! প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল একটা ফুলকে গোড়া থেকে কুট করে কাটার মত করে রিপার তার কাস্তে দিয়ে মানুষের আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়। এটাই মৃত্যু! নিস্তব্ধতা আর এই উপমা, এই দুইয়ে মিলে ঠিক সিনেমার মত একটা আবহ তৈরি হয় না? চাপা, ভারী একটা নৈঃশব্দের মধ্যে ধীর গতিতে একটা গোড়া কাটা ফুল গাছ থেকে ঝরে পড়ছে – এরকম একটা দৃশ্য তৈরি হয়ে যায় না মাথার মধ্যে? ঠিক এখানেই প্যাট্রিক রথফাসের ভাষার কারিকুরি! মাত্র তিনটা শব্দের একটা উপমা দিয়ে কী অসাধারণ একটা দৃশ্যকল্প বানিয়েছে দেখেছেন? তাহলে কেন টলস্টয়ের ভাষার সাথে তুলনা করবো না বলুন!
আমার মনে হয় প্যাট্রিক রথফাসের প্রত্যেকটি শব্দ চয়নের পেছনে এক বা একাধিক গভীর চিন্তা ভাবনা আছে। প্রথমবার পড়ার সময়ে শুধু লেখার টানেই পড়ে গেছি। তার পরে যতবার পড়তে গেছি - অনেক বাক্য, এমনকি শব্দও, নতুন নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে। বলা যায় রথফাসের বর্ণনা একসাথে তিন চারটা স্তরে কাজ করে। প্রথমবার পড়ুন, বুঝতে সমস্যা নেই। কিন্তু এর পরে যতবার পড়তে যাবেন, রথফাসের বাক্যগঠন আর শব্দ প্রয়োগ নতুন নতুন অর্থবহ রূপ নিয়ে ধরা দেবে।
সেই সাথে রেড হেরিং (আড়ালে লুকিয়ে থাকা তথ্য)। একটা উদাহরণ দিই। কভোথে (Kvothe – প্যাট্রিক রথফাস উচ্চারণ করে শুনিয়েছেন এমন – ক-এ হসন্ত দিলে যেমন হবে তেমন উচ্চারন হবে, ভ এর উপরে শ্বাসাঘাত নেই, ওথে উচ্চারন হবে জোর দিয়ে। লিখে ঠিক বোঝাতে পারছি না উচ্চারনটা) ওয়েস্টোন সরাইখানার মালিক। একটা স্ক্রাইলের (মাকড়সা দানব) মৃতদেহ এখানে নিয়ে আসার পর কভোথে গ্রামবাসীকে বোঝাতে পারে যে এটা একটা অতিপ্রাকৃতিক দানব। অতিপ্রাকৃত জীবদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হচ্ছে লোহা। এর পরে দেখা যায় কভোথে আর তার শিক্ষানবীশ বাস্টের মধ্যে কথোপকথন। যেখানে কোট (কভোথের ছদ্মনাম) জানায় গ্রামের কামার আগামী কিছুদিন খুব ব্যস্ত থাকবে (অবশ্যই অস্ত্র বানাতে)। তারপর বাস্টকে বলে তুমি চলে যেতে চাইলে আমি তোমাকে দায়ী করবো না। এখানকার চেয়ে তোমার যাওয়ার উপযোগী আরো ভালো ভালো জায়গা আছে। এতে বাস্টের আহত প্র্যতুত্তর আমি যেতে পারবো না। আর কে আছে যে আমাকে শেখাবে?
এই ছোট্ট কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়া হয়েছে। আমি প্রথমবার পড়ার সময় ধরতেই পারিনি, আপনারা অনেকেই হয়তো পেরেছেন। তথ্যটা হচ্ছে লোহার তৈরি অস্ত্র এবং তার সম্ভাব্য ব্যবহারের সম্ভাবনা যেখানে অত্যধিক, সেখানে বাস্টের না থাকাই শ্রেয়। অন্য কথায় লোহার তৈরি অস্ত্র বাস্টের জন্য মারাত্মক অর্থাৎ বাস্ট আসলে অতিপ্রাকৃত জগতের কেউ!
এই রকম অসংখ্য জিনিস ছড়িয়ে আছে রথফাসের লেখা পাতায় পাতায়।
এর সাথে যোগ করি রথফাসের বাক্য গঠন। না, শব্দ যোজনার জন্য্ বাক্য গঠন দেখতে বলছি না। বলছি বাক্য গঠনের বিস্তৃতির জন্য। একটু দীর্ঘ সময় ধরে চলা ঘটনার জন্য এক ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছেন, আবার দ্রুততালে চলা ঘটনার জন্য আরেক রকমের বাক্য ব্যবহার করেছেন। অনেকটা সিনেমার আবহ সঙ্গীতের মতো – স্পাইডারম্যান যখন ড; অক্টোপাসের সাথে লড়াই করছে তখন চরম উত্তেজনার সঙ্গীত, আবার এম জের সাথে আবেগে থরো থরো কথা বলার সময়ে রোমান্টিক মিউজিক!
এটা তো গেলো বাক্য গঠনের একটা স্তর। বাক্য গঠনের আরো স্তর আছে। এক জায়গায় হয়তো দীর্ঘ বাক্যে কোন কিছু বর্ণনা করছেন। পরবর্তীতে দেখা গেলো একই রকম দৃশ্য বা ঘটনার জন্য ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেছেন। কেন? এখানেই তো মজা! এই বাক্য গঠনের মধ্যেও কিন্তু মূল কাহিনীর সাথে ঐ দৃশ্য বা ঘটনার গুরুত্বের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে! যে ঘটনাটা কাহিনির সাথে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে এক রকম বাক্য, আবার কাহিনির সাথে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অন্য রকম বাক্য। একবার ধারাটা বুঝলে খেয়াল করে দেখবেন পুরো বইয়ে এই ধারার ব্যতয় ঘটেনি কোথাও! মাই গড! রথফাস কীরকম চিন্তাভাবনা করে প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ভাবলে মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে না? এর পাশাপাশি খেয়াল করুন অনুপ্রাসের প্রয়োগ। দেখবেন ভিন্ন ভিন্ন অনুপ্রাস গল্পের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসছে।
আরো অনেক কিছু ছিলো আলোচনা করার। কিন্তু লেখাটা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে সেসব দিকে আজকে আর যাচ্ছি না। পাঠকের ভালো লাগলে পরে হয়তো সেগুলো নিয়ে হাজির হবো। শেষ করবো রথফাসের লেখার যে দিকটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, সেটা দিয়ে। লেখার ছন্দ।
প্যাট্রিক রথফাস তাঁর বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় অনেক গান এবং কবিতা ব্যবহার করেছেন। তা তো ঠিক। কিন্তু অনেকেই সেটা করেছেন। গুরু টোলকিন থেকে শুরু করে হালের মার্টিন দাদু পর্যন্ত। তাতে এমন কি হলো? আসলে শুধু সেটা না, রথফাস তাঁর গদ্যের মধ্যেও ছন্দ, ছন্দের মাত্রা এবং কবিতা নিয়ে এসেছেন। এই জিনিসের প্রোপার অনুবাদ করার মতো ধৈর্য্য (এবং হয়তো সাধ্যও) আমার নেই। তাই ইংরেজী থেকেই উদাহরণ দিচ্ছি।
“And this is true of any fae?”
She shrugged and nodded. “have they the will, and know the way. There are a thousand half-cracked doors that lead between my world and yours.”
“How have I never heard of this? It seems it would be hard to miss, Fae dancing on the mortal grass. . . .”
She laughed. “but has not just this come to pass? The world is wide and time is long, but still you say you heard my song before you saw me singing there, brushing moonlight through my hair.”
I frowned. “Still, it seems I should have seen more signs of those who walk between.”
Felurian shrugged. “most fae are sly and subtle folk who step as soft as chimney smoke. some go among your kind enshaedn, glamoured as a pack mule laden, or wearing gowns to fit a queen.”
She gave me a frank look. “we know enough to not be seen.”
একটু ভিন্ন ধরনের, কিন্তু সাধারণ গদ্যের সাথে খুব একটা পার্থক্য নেই, তাই না? ফে(fae) জাতির সাথে কথা বলার সময়ে একটু ভিন্নতা আসতেই পারে হয়তো। ঠিক বলেছেন। কিন্তু এবার এই অংশটুকুকেই একটু ভিন্নভাবে সাজিয়ে দেখি। পড়ার সময়ে সাত মাত্রার ছন্দের কথা যদি মাথায় রাখি তাহলে দেখতে পাই -
“And this is true of any fae?”
She shrugged and nodded. “have they the will, and know the way.
there are a thousand half-cracked doors
that lead between my world and yours.”
“How have I never heard of this?
It seems it would be hard to miss,
Fae dancing on the mortal grass. . . .”
She laughed. “but has not just this come to pass?
the world is wide and time is long,
but still you say you heard my song
before you saw me singing there,
brushing moonlight through my hair.”
I frowned. “Still, it seems I should have seen
more signs of those who walk between.”
Felurian shrugged. “most fae are sly and subtle folk
who step as soft as chimney smoke.
some go among your kind enshaedn,
glamoured as a pack mule laden,
or wearing gowns to fit a queen.”
She gave me a frank look. “we know enough to not be seen.”
ডেনা আর কভোতের একটা দৃশ্য। Denna’s expression grew rueful and she sighed. “I used to hope they’d disregard the book with age. Instead I’ve found they’ve merely turned a page.”
She held up her hand, displaying a pair of rings. “Now instead of roses they give gold, and in the giving they grow sudden bold.”
এটাই কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে হয়ে যায় -
Denna’s expression grew rueful and she sighed. “I used to hope they’d disregard the book with age.
Instead I’ve found they’ve merely turned a page.”
She held up her hand, displaying a pair of rings. “Now instead of roses they give gold,
and in the giving they grow sudden bold.”
মজার না? দুর্দান্ত ছন্দ প্রয়োগ। আমার কিন্তু খুব ভালো লেগেছিলো। আপনারও কি ভালো লেগেছে? বেশ। বেশ। দেরি না করে কিং কিলার ক্রনিকল পড়ুন তাহলে। (পড়ে থাকলে আবার পড়ুন)। ওয়েলকাম টু প্যাট’স ওয়ার্ল্ড!
আর এই লেখাটা পড়ে কেমন লাগলো, জানাবেন প্লীজ। আপনাদের আগ্রহ থাকলে কিং কিলার ক্রনিকল এবং রথফাসের লেখা আরো আলোচনা করার ইচ্ছে রাখি।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
-অয়ন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ