- বই : কপালকুণ্ডলা পিডিএফ ডাউনলোড
- লেখক : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- জনরা : রোম্যান্সধর্মী উপন্যাস
- ব্যাক্তিগত রেটিং : (৯/১০)
- ফরমেট : PDF, E-pub
- Last Update : September, 09, 2022
"পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?" আচ্ছা, আমরাও কি জীবন নামের এই গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া কোনো পথিক? যেখানে সুখ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মতো আবেগ গুলো বনের বিশাল বৃক্ষ সমূহের ন্যায়ই পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে? হয়তো সেই চিরাচরিত আবেগ, আশা, আকাঙ্খা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই জীবনের আসল সার্থকতাকে খুঁজে পাবো?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (১৮৩৮-১৮৯৪), বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা বলা হয়ে থাকে। তাঁর উপন্যাসেই সর্বপ্রথম একটি সার্থক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাস এবং কল্পনার সংমিশ্রণে লেখা তার গদ্য গুলি বরাবরই পাঠকের মন জয় করে এসেছে। যদিও বর্ণবাদী বলে ওনার সমালোচনাও আছে বিস্তর। শেষের দিকে এসে ওঁনার উপন্যাসে সাহিত্য রসের থেকে ধর্মীয় আলোচনার ছোঁয়া বেশী চলে এসেছিলো বলে উপন্যাসের চাহিদা কমে যায়। ওঁনার প্রবন্ধ গুলিও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
কাহিনীর শুরু হয় যখন নবকুমার নাম্নী এক যুবক দুরাবস্থার কবলে পড়ে সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী এক জনমানবহীন গহীন বনে আটকা পড়ে যায়। ঐ বনেই নবকুমারের সাথে গল্পের মূল নায়িকা কপালকুন্ডলা এবং খলনায়ক কাপালিকের সাক্ষ্যাৎ হয়। কাপালিক ছিলেন কপালকুণ্ডলার পালক পিতা। তিনি কপালকুন্ডলাকে নিজের কাছে রেখে পালন করেছিলেন তাঁর আরাধ্যা দেবী ভৈরবীর চরণে বলি দিয়ে সাধনায় সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে। কাপালিক বনে হারিয়ে যাওয়া নবকুমারকেও চেয়েছিলেন বলি দিতে। কিন্তু বাঁধা দেয় কপালকুণ্ডলা। বাঁচিয়ে নেয় নবকুমারকে। প্রত্যুপকারের দায়িত্ব এবং ষোড়শী যোগিনী কপালকুণ্ডলার রূপে মোহিত হয়ে তাকে বিবাহ করে নিজের গ্রামে নিয়ে আসে নবকুমার। পথে দেখা হয় তার প্রথমা পত্নী পদ্মাবতীর ( যিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বলে নবকুমারের বাবা আর তাকে নিজের ঘরে তোলেননি) সাথে। ওরফে মতিবিবি। নবকুমার যদিও প্রথম দেখায় তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে চিনেছিলো। গল্পে দেখা যায় যে, মতি বিবি একদিকে নবকুমারকে পাগলের মতো ভালোবাসছে কিন্তু নবকুমারের মনে শুধুই কপালকুণ্ডলা। আবার অন্যদিকে কাপালিকের ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া এই তিন জনেরই জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে নিয়ে আসে।
মতিবিবি কপালকুণ্ডলাকে হিংসা করলেও পরবর্তীতে সেই হিংসার আগুনকে আর ধরে রাখতে পেরেছিলনা। কাপালিকের ষড়যন্ত্রের থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলো তাকে। কিন্তু পারেনি। অন্যদিকে নবকুমার কাপালিকের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সন্দেহ করে কপালকুণ্ডলাকে। তার ধারণা জন্মেছিল যে তার প্রিয়া হয়তো পরকীয়ায় লিপ্ত। সেই ভুল ধারণা ভাঙতে অনেক দেরী হয়ে যায়। গল্পের অদ্ভুত বিষয় এই যে, কপালকুন্ডলা এক বারের জন্যও বোঝেনি যে সে নিজে তিন-তিন জন মানুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। গল্পের শেষটা মোটেও পূর্বাকাঙ্খিত ছিলনা। বইটা পড়ে আপনার জেনে নেয়ার জন্য রেখে দিলাম সেটা।
কপালকুণ্ডলা বন্য প্রকৃতির কোলে বড় হয়েছিলো। বিবাহ "বন্ধনে" আবদ্ধ হয়ে সে যখন নবকুমারের গৃহে ঘরণী হয়ে আসে, সেই গৃহ তার কাছে কারাগারের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলনা। সে স্বাধীনতা চাইতো। সেই বনবাসিনীর নর-নারীর প্রেমের সম্বন্ধে ধারণা ছিলনা বললেই চলে। তার মনে ছিল আবাল্য পূজিতা দেবী ভৈরবীর প্রতি অসীম ভক্তি ও নির্ভরশীলতা। তার মন সমাজে বাস করা মানুষের বানানো প্রথা এবং সংস্কারের বশবর্তী ছিলনা। তাকে নিয়ে নবকুমারের মনে যে অসত্য সন্দেহ ছিল, তা তার কাছে নিছকই অর্থহীন মনে হতো। সে মানুষের উপকার করতে চাইতো। সে মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখতে চাইতো। নারী-পুরুষের ভেদ ছিলনা তার কাছে। তার মধ্যে এক অদ্ভুত সারল্যের ছবি এঁকেছেন লেখক। এ হয়তো শুধু বনের গভীরে প্রকৃতির কোলে লালিতো হলেই মানুষের মধ্যে জন্মে। লেখক কপালকুণ্ডলার চরিত্রে যে উদারতাকে দেখিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল।
নবকুমারের চরিত্রে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখা যায়। যেখানে আছে গভীর ভালোবাসা। আবার সেই ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয়া হিংসা ও সন্দেহ। আবার সেই ভালোবাসার জন্যই সম্পূর্ণ অবিশ্বাসও করতে পারতো না। সমাজের সংস্কারের থেকে সে মুক্ত ছিলনা। ভালোবাসা প্রাধাণ্য পাবে নাকি আবাল্য লালিত সংস্কার, সেটা নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যেতে দেখা গেছে তাকে যখন কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে ঘরে তোলার কথা ওঠে তার।
কাপালিক চরিত্রটিকে যদি স্বার্থপর বলা হয় তবে খুব ভুল হবেনা। ক্ষমতা চাইতো সে। তার জন্য মানুষকে ব্যাবহারও করতে ছাড়েনি। আবার সেই ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যেই এক কুড়িয়ে পাওয়া শিশুকে মানুষ করে তুলেছে। আমার মতে এমন চরিত্র আমাদের এই জাগতিক সমাজেও যথেষ্ট রয়েছে। যারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব কিছু করতে পারে।
মতিবিবি চরিত্রটি বেশ বিচিত্র। প্রতুৎপন্নমতী এই মানুষটি হিংসায় জ্বলে যে মানুষটার ক্ষতি চেয়েছিল, সেই মানুষটারই প্রাণ রক্ষার্থে এগিয়ে আসে। সেখানে একটা শর্ত অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই শর্ত না থাকলেও মানুষটির জীবন রক্ষার জন্য চেয়ে বা না চেয়ে অবশ্যই সেই শর্তটি পালন করতেই হতো। এমনই এক পরিস্থিতি ছিল তখন। মতিবিবি চরিত্রে হিংসা ও পরার্থপরতা এক সাথে বাস করেছে। সেখানে আবার আছে বাল্যকালে ছেড়ে আসা স্বামীর জন্য ভালোবাসার টান।
কপালকুণ্ডলাকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক রোম্যান্সধর্মী উপন্যাস। তবে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এইখানে ”রোম্যান্স” এর চেয়ে "রোমাঞ্চ" বেশী পেয়েছি।গল্পের শুরু থেকে শেষ অব্দি লেখক পাঠককে বেঁধে রাখতে পেরেছেন। লেখকের প্রকৃতির অপরূপ বর্ননা, নারী রূপের বর্ননা সত্যিই অসাধারণ। তবে আমার মনে হয়, রূপের বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি এই উপমহাদেশে প্রচলিত যে "সৌন্দর্যের অন্যায় মানদণ্ড", তাকে অনেক বেশী সমর্থন দিয়েছেন। ব্যাপারটা পাঠকের কাছে একটা ভুল বার্তা দেয়। এছাড়া বইটার অন্য দোষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কিছুটা ফ্যান্টাসির ছোঁয়াও পাবেন আপনি বইটা পড়ে। আপনি হারিয়ে যাবেন গভীর অরণ্যে কিংবা কোনো সমুদ্রের তটে কিংবা নিতান্তই সাধারণ কনো গৃহস্হের গৃহে কিংবা অসাধারণ মোঘল রাজপ্রাসাদে। পাঠক হয়তো দেখেছেন আমি বেশ কিছু জায়গা খোলসা করে বলিনি আপনাদের কাছে। সেটা আপনাদের নিজেদের বইটা পড়ে জানার জন্য রেখে দিয়েছি। সাধু ভাষায় হয়তো একটু হোঁচট খাবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়ে ঠোকবেন না।
রিভিউ ক্রেডিট,
বিদিশা মন্ডল,
ভলান্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....