মেমসাহেব PDF Download Available Now
নিমাই ভট্টাচার্য
দে'জ পাবলিশিং
বাঙালির জীবনে বিরহ বলতেই চলে আসে বৃন্দাবনের গোপী রমণী রাধিকার বিষণ্ণ বদন। কৃষ্ণের বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গজুড়ে সৃষ্ট প্রণয়-আকুলতা, বিরহ-ব্যকুলতা আজও যেন বাংলার আকাশে অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়ায়। ভাদ্র মাসে প্রবল বর্ষণে ভরে গেছে সকল খাল-বিল-নদী-নালা। চতুর্দিকে আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। মিলনের অপূর্ব পরিবেশ। এমন সময় কাছে নেই কৃষ্ণ। চলে গেছে অনেক দূরে। তাই রাধিকা তার সখীকে ডেকে বলছে,
"এ সখী হামারি দুঃখের নাহি ওর,
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।"
কাজেই সেদিনের ঘন বরষা যেন রাধা-হৃদয়ের ব্যথা নিঃসৃত জল, সন্ধ্যায় ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক যেন বিরহগীতিকা।
সেই থেকে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যের অলিতে-গলিতে রাধারাই কেঁদে ফেরে। কৃষ্ণরা যেন কাঁদতে পারে না,তাদের যেন বিরহ নেই, তারা প্রস্থরহৃদয়। আদতে কি তাই? পুরুষের হৃদয় কি বিগলিত হয় না? পুরুষ কি কাঁদে না, প্রিয়াবিয়োগে নরকুল কি পাগলপারা হয়ে ওঠে না? হ্যাঁ পাঠক, হয়। পুরুষ দুমড়ে যায় বেদনায়, তলিয়ে যায় শূন্যতায়; মিথ্যা হয়ে যায় নরজীবনের সব অর্জন। তারই প্রমাণ মেলে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্যের 'মেমসাহেব' উপন্যাসে।
যেখানে কৃষ্ণবর্ণা এক রমণীর প্রেমে পড়ে বাচ্চু। দিনে দিনে গভীর হয়ে ওঠে সম্পর্ক। সপ্তাহ, মাস, বছর গড়িয়ে না ফেরার স্তরে পৌঁছে যায় সম্পর্কের চাকা। এরপর একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত দেখা দেয় বাচ্চুর ভাগ্যাকাশে। অধরা হয়ে যায় মেমসাহেব। মধ্যগগনের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবস পরিণত হয় অমাবস্যার মহানিশায়। আহা জীবন! বাচ্ছু কেঁদে ফেরে; কেঁদে ফেরে আকাশ-বাতাস, ভূপৃষ্ঠের সকলেই জানায় সমবেদনা, প্রণয়লীলার সাক্ষী সমস্ত স্থান-কাল ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু হায়! মেমসাহেব ফেরে না; সে চলে গেছে অজানা পথে; অচিনপুরে।
বিদগ্ধ পাঠক! একজন নারী একজন পুরুষের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
একজন নারী কীভাবে একজন সাধারণ সাংবাদিককে অসাধারণ রিপোর্টারে পরিণত করতে পারে, একজন নারী কীভাবে একটা পুরুষকে নিদারুণ দীনতা থেকে দারুণ সমৃদ্ধ করতে পারে, একজন নারী কীভাবে একটা অগোছালো পুরুষকে সুগোছালো বানাতে পারে, একটা যুবতী কীভাবে একটা আনস্মার্ট যুবককে স্মার্ট বানাতে পারে, একজন নারী কীভাবে একটা স্বপ্নহীন পুরুষকে স্বপ্নীল করতে পারে, একজন নারী কীভাবে একজন পুরুষকে তার জীবনের সকল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে, কীভাবে তমসাচ্ছন্ন বন্ধুর পথকে আলোকোজ্জ্বল মসৃণ বানাতে পারে, কীভাবে পারে জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তির স্বাদে রূপান্তরিত করতে, কীভাবে সে পারে নির্মোহ একনিষ্ঠ মানুষে পরিণত করতে, একটা নারী কীভাবে একটা পুরুষের জীবনে অনিন্দ্যা সুন্দরী ও ঐশ্বর্যবতী নারীদের আগমনের সব উন্মুক্ত দ্বারকে চিররুদ্ধ করে দিতে পারে, একজন নারী কীভাবে তার বক্ষকে একটা পুরুষের জন্য স্বর্গ বানাতে পারে, আলগা অভিমানের আড়ালে একজন নারী তার পুরুষটাকে কতটা ভালোবাসতে পারে, না না বলে ঠিক কতটা কাছে পেতে চাইতে পারে, কীভাবে একজন নারী তার যৌবনের সবটা উজাড় করে, দেহের সব উষ্ণতা দিয়ে পুরুষকে স্বর্গীয় সুখসুধায় ভাসাতে পারে, সর্বোপরি একজন নারী একটা পুরুষের জীবনে কতটা আশীর্বাদ নিয়ে আসতে পারে তার এক অনন্য দলিল মেমসাহেব উপন্যাসটি।
জানি না উপন্যাসটির বাস্তব ভিত্তি লেখকের জীবনে ছিল কিনা তবে না থাকলেও গল্পটি অমূলক নয়। মনে হয়েছে যুগেযুগে প্রেমের এই অনিবার্য মহিমা ছিল। ধূলির ধরায় আবহমানকাল কিছু মেমসাহেব ছিল, আছে এবং থাকবে। নিমাই ভট্টের মেমসাহেবের মত আরেক মহীয়সী রমণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের ভোর বেলায়। যার নাম আনোয়ারা। নজিবর রহমান আনোয়ারা চরিত্রকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে আর পাওয়া যায় না। তবে বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে নিমাইয়ের মেমসাহেব আনোয়ারার অনুগামী। মজার ব্যাপার হলো উপন্যাসদুটি দুধর্মের দুই নারীকে চিত্রিত করে। তবে মেমসাহেব আনোয়ারার মত ধর্মপ্রাণা নয়, বরং সে আধুনিক। জীবন-যৌবনের ব্যাপারে সে উদার মনোভাব পোষণকারী।
মেমসাহেবে একটা জিনিসকে মননশীল লেখক নায়কের প্রতি নায়িকার ভালোবাসার অন্যতম নমুনা হিসেবে দেখিয়েছেন যা কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর। আর তা হলো, বাচ্চুকে পূর্ণরূপে ভালোবাসার জন্যে, স্বামীর যাতে কোন ধরনের অযত্ন না হয়; সুখের পথে চাকুরি যাতে বাঁধা না হয়, যাতে মেমসাহেব বাচ্চুর জীবনে প্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে থাকতে পারে সে জন্য মেমসাহেব বিয়ের পর চাকুরি ছেড়ে দিতে চায়। এ জায়গায় অর্থ-বিত্তের চেয়ে লেখক সম্ভবত সাংসারিক ঐশ্বর্যকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন। অথবা লেখকের বিশ্বাস এমন যে, পারিবারিক জীবনকে নিষ্কন্টক ও সুখময় করার জন্য স্ত্রীর চাকুরি বাঁধা হতে পারে। সে যাইহোক, এ কথা না বললে অন্যায় হবে যে, মেমসাহেব এমন এক প্রেমিকা যার প্রেমের দরিয়া ছিল কূলহীন।
শালীন ভাষায় অন্তরঙ্গতার বর্ণনায় লেখকের মুনশিয়ানা অনস্বীকার্য। এটা পাঠককে কিছুটা শৃঙ্গার রস আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। বইটির আরেকটা বিশেষ দিক হলো-- পুরো উপন্যাসটা মূলত অনেকগুলো পত্রের সমাহার যা লেখা হয়েছে দোলা বৌদি সম্বোধনকৃত এক অধরা নারীর নিকট।
সাহিত্যিক উৎকর্ষের বিবেচনায় বলতে হবে মেমসাহেব সফল সৃষ্টি। এর ভাষা এতটা প্রাঞ্জল যে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সব শ্রেণীর পাঠকই এই বই থেকে রস আস্বাদন করতে সক্ষম হবেন। উদাহরণ হলো, বইটি পড়তে পড়তে আমাকে ৩-৪দিনের একটি সফরে যেতে হয়েছিল। ফিরে আসার সাথে সাথে আমার দশম শ্রেণি পড়ুয়া চাচাতো বোন সোৎসাহে বলল, "ভাইয়া! আপনার আগেই আমি মেমসাহেব পড়ে ফেলেছি।"
বস্তুত, গ্রন্থের উপাখ্যানে মেমসাহেব যেমন অনন্যা তেমনি বইয়ের সাবলীল বর্ণনা ও মধুর ব্যঞ্জনা লেখককে করে তুলেছে অনন্য। সুতরাং উপন্যাস হিসেবে মেমসাহেব পেয়েছে দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। PDF Download
সবশেষে বলবো, মেমসাহেব পৃষ্ঠায় ও জীবনে সংক্ষিপ্ত হলেও বাস্তবে তার প্রয়োজনীয়তা সুদীর্ঘ।
খুরশীদ আলম
বিসিএস(শিক্ষা)
১৭.০৯.২০২২
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....