নো এক্সিট : টেইলর এডামস | No Exit By Tailor Adams (Bangla Anubad)

  • বই : নো এক্সিট 
  • লেখক : টেইলর এডামস
  • অনুবাদক : আশিকুর রহমান
  • প্রচ্ছদ : আদনান আহমেদ রিজন
  • প্রকাশনী : বুকস্ট্রীট
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৩০৯
  • মূদ্রিত মূল্য : ৫৮০ টাকা
  • Review Credit : Zakaria Minhaz


মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলো কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ডার্বি৷ কিন্তু প্রবল তুষার ঝড়ে আটকা পড়লো একটা রেস্টশপে। যেখানে তার সাথে আটকে আছে আরো ৪ জন। এই অবস্থায় সে বাইরে পার্ক করা একটা গাড়িতে বাচ্চা একটা মেয়েকে বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করে। সে জানে যে ঘরের বাকী ৪ জনের একজন এই মেয়েটাকে কিডন্যাপ করছে। শুরু হলো চোর পুলিশ খেলা। কিডন্যাপারকে শনাক্ত করতে হবে, মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে এবং প্রবল তুষার ঝড়ের মাঝে টিকে থাকতে হবে গোটা রাত। 

পর্যালোচনাঃ মাই গড 😱!!! সিম্পলি আউটস্ট্যান্ডিং। বইটা নিয়ে লেখার দরকার নেই, আপনাদেরও এই রিভিউ পড়ারই দরকার নেই৷ স্রেফ বইটা কিনে পড়া শুরু করুন। আপনি থ্রিলারপ্রেমী এবং আপনার হাতে একটা বইই কেনার মতো টাকা আছে; সবার আগে এই বইটাই কিনুন। আপনার সংগ্রহে অনেক বই পড়ে আছে; সবার আগে এই বইটাই পড়ুন। তবে সাবধান, হাতে সময় নিয়ে এরপর বইটা পড়া শুরু করবেন।

টেইলর এডামস এর এই দূর্দান্ত সাসপেন্স থ্রিলার একদম শুরু থেকেই এমনভাবে পাঠককে আকড়ে ধরবে যে, পাঠক কোনোভাবেই বইটা ছেড়ে উঠতে চাইবে না। নিজের একটা উদাহরণ দেই, যেদিন বিকেলে বইটা প্রথম পড়া শুরু করি, সেদিনই সন্ধ্যায় আমার ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার কথা ছিলো। আমি তখন মাত্র বন্দী মেয়েটা মুক্ত হবে হবে টাইপ জায়গা পর্যন্ত পড়েছিলাম। এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতান্তই বাধ্য হয়েই বইটা রেখে ডাক্তারের কাছে যাই৷ বিশ্বাস করুন, সারাক্ষণই আমার মনে হয়েছে; আহারে!! মেয়েটা মুক্ত হতে পারলো তো?? মুক্ত হয়েই বা কি করবে, কোথাও তো যাওয়ার জায়গা নেই!! এরপর আরো একবার আমাকে গ্যাপ দিতে হয় বন্ধুদের আগমনের কারনে। তখনো সারাটা সময় পুরো মনযোগ বইয়ের মাঝেই আটকে ছিলো, আড্ডায় আর মন বসাতে পারছিলাম না।

নিজের কথা বাদ দিয়ে বইয়ের কথা বলি এবার। বইয়ের মূল চরিত্র ছাড়া আর বাকী থাকে মাত্র ৪ জন কারেক্টার। এই অল্প কয়টা চরিত্র নিয়ে লেখক যে 'খেল' টা দেখালেন তা আমি আজীবনও ভুলবো না। মেয়েটাকে আবিষ্কারের পর থেকে প্রতি সিক্যুয়েন্স ছিলো টানটান উত্তেজনাপূর্ণ। বইয়ে তিন ধাপে ৩টা মেজর টুইস্ট আছে। যার মধ্যে পাঠক হয়তো প্রথমটা অনুমান করে ফেলতে পারবেন। এমনকি যদি ৩টা টুইস্টই আপনি অনুমান করে ফেলতে পারেন, তাতে করেও বইটা পড়ার আগ্রহ আপনার বিন্দুমাত্র কমবে না। "রোলার কোস্টার রাইড" শব্দটা এই ধরণের বইয়ের ক্ষেত্রেই পারফেক্টলি মানিয়ে যায়৷ 

এই বইতে সূত্র খুঁজে খুঁজে রহস্যের সমাধাণ নেই। রহস্য আপনার সামনেই, সমাধানটাও জানেন; কিন্তু সেটা সম্পন্ন করাটা যে কি পরিমাণ কঠিন তা ডার্বির প্রতিটা সিচুয়েশন আপনাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিবে। ছোট্র একটা এড়িয়ার ভিতরে বন্দি অবস্থায় যে ইঁদুর বেড়াল খেলাটা ডার্বি আর কিডন্যাপারের মধ্যে ঘটে তার পুরোটা অংশ পাঠকের নার্ভের উপর সর্বদা প্রেশার দিয়ে যাবে। দমবন্ধ করা সব ঘটনাবলী পাঠককে আয়েশ করে বইটা পড়তে দিবে না। শুয়ে থাকলে বারবার উঠে বসে পড়বেন অজান্তেই, আর বসে থাকলে কখন যে দাঁড়িয়ে গেছেন তা টেরও পাবেন না। এমনকি সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও লেখক একেবারে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত সাসপেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন, এই ব্যাপারটাও বেশ ভালো লেগেছে। 

আর চরিত্রগুলোর কথা কি বলবো। আমাদের মতোই অতি সাধারণ ভুলে ভরা মেয়ে ডার্বি। যে হটাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয় যেভাবেই হোক অসহায় বাচ্চাটাকে বাঁচাতেই হবে। সাথে থাকে তার মায়ের অসুস্থতা এবং তার সাথে মায়ের দূরত্বের হাহাকার। ডার্বির আপ্রান প্রচেষ্টার সাথে বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া প্রতি মুহুর্তে মনে করিয়ে দিবে যে সে আর দশটা সাধারণ মানুষদের মতোই কেউ একজন। ছোট্র মেয়ে জে' এর চরিত্রটাও দূর্দান্ত। এই মেয়ের দূর্দশা দেখে মায়ায় যেমন আপনার মন আর্দ্র হবে, তেমনি ছোট্র মাথার বুদ্ধি দেখেও আপনি পুলকিত হবেন। এছাড়াও আছে আ্যশলি, লার্স, এড এবং স্যান্ডি। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গায় সমান ভূমিকা রেখেছে। প্রতিটা চরিত্রেরই মানসিক অবস্থা পাঠক অনায়াসে অনুভব করতে পারবে। থ্রিলার বই সাধারণত দুইবার পড়া হয় না, তবুও এই বইটা আমি আরেকবার পড়তে রাজী শুধুমাত্র চরিত্রগুলোকে আরো একবার অনুভব করার জন্য।

পাশার দান একবার ডার্বির দিকে, তো একবার কিডন্যাপারের দিকে। সাথে আছে মানসিক দ্বন্দ, ভুল করা, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার সঠিক দিকে এগিয়ে যাওয়া, মোবাইলে চার্জ না থাকা, যাও বা আছে খারাপ আবহাওয়ায় নেটওয়ার্ক না থাকায় সাহায্য চাওয়ার উপায় না থাকা, হুটোপুটি, প্রতি মুহুর্ত পালিয়ে বেড়ানো, আ্যকশন, বেঁচে থাকার তাড়না, বাঁচিয়ে রাখার তাড়না, আবেগ, উন্মত্ততা, অস্ত্র, রক্ত আর খুন৷ একটা বইয়ে আর কিইই বা চাওয়ার বাকী থাকে!!

বইয়ের শেষাংশে এন্টাগনিস্টের মৃত্যুটা যদিও সামান্য নাটকীয় বলা যায়। তবে ওই সময়ে তার মাথায় ঘটে চলা যেসব চিন্তাভাবনা লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সেটা আমি প্রচন্ড উপভোগ করেছি। লেখক চেয়েছেন প্রতিটা সিকুয়েন্সে পাঠক যেনো একটু হলেও ধাক্কা খায়। এবং এই ব্যাপারটায় লেখককে বেশ সফলও বলা যায়। সত্যি বলতে বইটা নিয়ে আরো অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এতে আপনাদেরই স্পয়লার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় বলতে পারছি না। এই বছরে আমার পড়া সবচেয়ে সেরা বই, যার প্রতিটা পৃষ্ঠা তড়িয়ে তড়িয়ে উপভোগ করেছি আমি।

অনুবাদঃ অনুবাদ এক কথায় দূর্দান্ত। আমি মোটামুটি পুরো বইটাই মূল ইংরেজীর সাথে তুলনা করে দেখেছি। মূল লেখকের গল্পের আবহ, ইনটেন্স সিচুয়েশন, টোন প্রতিটা জিনিস একদম পারফেক্টলি অনুবাদে ফুটিয়ে তুলেছেন আশিক ভাই। কিছু জায়গায় নিজস্ব কিছু সাহিত্যরসও ব্যবহার করেছেন। যা সব জায়গায় ভালো লাগলেও, দু একটা জায়গায় ভালো লাগেনি। যেমন, "ঠিক হ্যায়", "পাতা হ্যায়" এই দুইটা হিন্দী শব্দ মাত্র একবার করে ব্যবহার করলেও, তা ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগেনি আমার। আর বাদবাকী সবকিছু বইটির মতোই দূর্দান্ত। মোটকথা "মাখন" লেভেলের অনুবাদ।

ব্যক্তিগত রেটিংঃ ১০/১০ (আমি নিতান্তই একজন সাধারণ পাঠক, যার কাছে বই থেকে এন্টারটেইনমেন্ট পাওয়াটাই মূখ্য৷ আর তাই এই বইটা আমার ক্ষেত্রে মাস্টারপিস মনে হয়েছে। #মাস্টরিড, মাস্টরিড, মাস্টরিড)

প্রোডাকশনঃ প্রশংসার পর্ব শেষ, সমালোচনা পর্ব শুরু!! প্রথম কথা বইয়ের কাগজ এতো মোটা হতে হবে কেনো?? এটা কতো জিএসএম এর কাগজ তা আমার জানা নেই। তবে একই সময়ে এটার সাথে আমি গ্রন্থরাজ্যের দিমেন্তিয়া হাতে পেয়েছিলাম। দুইটা বইয়ের মাঝে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার ব্যবধান থাকলেও, বইয়ের সাইজ এবং ওজন একই লেগেছে আমার কাছে। এইদিকে এতো মোটা কাগজ দেয়ার পরেও আমার কপিটায় শেষের দিকের কিছু পৃষ্ঠায় কালি লেপ্টে গেছে, আবার এক পাতার লেখা অন্য পাতায় ভিজিবল হয়ে গিয়েছে। বাঁধাইও দূর্বল লেগেছে। যদিও প্রচ্ছদটাকে মোটেও খারাপ বলা যাবে না, তবে এই প্রচ্ছদটা মুভি থেকে নেয়া। যেহেতু রিজন ভাইয়ের প্রচ্ছদ আমার বরাবরই ভালো লাগে, তাই আমি মনে করি উনার ক্যাপাবিলিটি অনুসারে এই বইটা এরচেয়ে বেটার প্রচ্ছদ ডিজার্ভ করে। 

এবং বইয়ের দামটাও আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। আমাদের দেশের থ্রিলার ঘরানার অনুবাদকদের ফর্মা প্রতি সম্মানীর ব্যাপারে হালকা আইডিয়া আছে, এর পাশাপাশি অনুনোমোদিত অনুবাদ হিসাবে এই বইটার মূদ্রিত মূল্য আরো অনেক কম হওয়া উচিত ছিলো। তুলনা করছি না, তবে ছাড় হিসাব করলেও এমনকি বিবলিওফাইলের (যাদের বইয়ের দাম বেশী নিয়ে হারহামেশাই কথা শোনা যায়) অনুমোদিত অনুবাদ থেকেও এই বইটার দাম বেশী মনে হয়েছে। আমি মনে করি কাগজের মান এবং মূদ্রিত মূল্য আরো কম রাখলে, বইটা হয়তো আরো বেশী মানুষের কাছে আরো দ্রুত পৌছাতো। তবে, এরপরেও বলবো বইটা এতোই ভালো যে এই টাকাটা একেবারে কড়ায় গন্ডায় উসুল হয়ে যাবে পাঠকদের। 

পরিশিষ্টঃ বইপাড়ায় আমার শুরু থেকেই আমি এটা সেটা ভুল নিয়ে আওয়াজ তোলা শুরু করি। বিশেষ করে অনুবাদ নিয়ে ভুল ধরে বেশ অনেক কন্ট্রোভার্সিও ক্রিয়েট করেছি। এবং এটা নিয়ে অনেকের সাইবার বুলিং এরও স্বীকার হতে হয়েছে আমাকে। তখন যে গুটিকয়েক মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার একজন এই আশিকুর রহমান ভাই। মজার ব্যাপার যে এই বইয়ের প্রচারণা পোস্ট দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি জানতামও না উনি যে একজন অনুবাদক। আমি উলটা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উনার সাথে কথা বলতাম, জায়গায় জায়গায় মেনশন দিয়ে বেড়াতাম!! মানুষটা এতোটাই নির্মোহ যে নিজের মুখে একবারও আমাকে বলেননি যে তিনি আসলে "ওই পাড়ের" একজন মানুষ। থ্রিলারে এটা উনার প্রথম কাজ। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি থ্রিলারে উনার কাছ থেকে আরো বেশী কাজ আশা করবো। পাঠকদেরকে এমন দূর্দান্ত একটা বই উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। 

পুনশ্চঃ হুদাই ধন্যবাদ Shahalul Tanzim ভাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ