নরম কাঁধের মানুষ

|| নরম কাঁধের মানুষ ||

নরম কাঁধের মানুষ—বাক্যটা সম্ভবত বাংলা ভাষায় অতটা পরিচিত নয়। মূলত গড়ে উঠেছে আরবি বাকরীতির ভেতর। আরবিতে ব্যবহৃত রূপটি হলো—লায়্যিনুল জানিব। একেবারে শাব্দিক অর্থ ধরলে—এমন মানুষ, যার পার্শ্ব নরম। কিন্তু এর দ্বারা তারা বুঝায় হলো চরিত্রের সহজতা, আচরণের কোমলতা এবং সম্পর্কের বন্ধুবাৎসল্য। সব মিলিয়ে মানুষটা এমন হওয়া, যার কাছে নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়, পাশে গিয়ে বসলে আহত হতে হয় না; বরং স্বতঃস্ফূর্ত বিমল এক আনন্দ ও ভালোলাগায় জুড়িয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত প্রান্তর। বাক্যটা বাংলায় প্রচলিত না হলেও শব্দ তিনিটির যৌথ উপস্থিতি ও শাব্দিক সমর্থনে অর্থ অস্পষ্ট নয়। বাংলার নিজস্ব শব্দ দিয়ে বলতে পারি—সহজ মানুষ। আমার অভিজ্ঞতা মতে এই সহজ মানুষ হতে পারাটা সহজ নয় মোটেই।

একজন মানুষ কখন সঙ্গতভাবে আকর্ষণীয় রকমের সহজ হয়ে উঠতে পারে? এ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। নিজের সে ভাবনাটি খুঁটিয়ে বলতে গেলে দীর্ঘ সময় ও পরিসরের প্রয়োজন; তারচেয়ে জীবনে সহজ যে মানুষগুলোকে পেয়েছি, তাদের সাথে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে মৌলিক কয়েকটি দিক বলি শুধু।

সকল বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের সারনির্যাস হিসেবে আমি প্রথমেই একটা শব্দ বলব—ইতিবাচকতা। এই শব্দটা বুঝার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা ভুল করি। ইতিবাচকতা মানে কিন্তু একচেটিয়াভাবে হ্যাঁ-ধর্মিতা নয়। অর্থাৎ ইতিবাচক হওয়ার জন্য আমাকে সর্বদা হ্যাঁ বলতে হবে এমনটা জরুরি নয়। মর্মের দিক থেকে শব্দটি আরও প্রশস্ত ও গভীর। আপনি হ্যাঁ বলতে পারবেন, না-ও বলতে পারবেন। কিন্তু আপনার আচরণ, কথা, দৃষ্টি ও অভিব্যক্তি থেকে পাশের মানুষটি যেন কখনো নিরাশার শিকার না হয়। যেন আহত ও অপমানিত বোধ না করে। অনুভব না করে যেন পরাধীনতা ও ভীতি।

এর সাথে বড় আরও কিছু ব্যাপার হলো—নিরাপত্তাবোধ, সততা, আমানতদারিতা, কল্যাণকামিতা, সম্মান প্রকাশের উদারতা, উৎফুল্লতা, প্রয়োজনীয় রসবোধ, জ্ঞানের পরিশিলীত ও পরিমার্জিত প্রকাশ এবং প্রয়োগ, মমতা ও দয়া, বিনয় ও ধীরতা। এসব আসলে এমন ঘটা করে বলবার কিছু নয়। সবারই জানা আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিষয়গুলোর সম্মিলন ঘটিয়ে রসায়নটা তৈরি করতে পারছি কি না।

একটু বুঝমান হবার পর থেকে আমি অনেকের শক্ত আচরণ ও অস্বস্তিকর অভিব্যক্তির শিকার হয়েছি। যার ফলে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছি, ক্লান্ত ও বিষাদগ্রস্ত হয়েছি। এবং তার আশপাশ থেকে সরে এসেছি। আচরণ শক্ত, আড়ষ্ট, অস্বস্তিপূর্ণ মানুষদের সঙ্গ আমি কখনোই নিতে পারি না। এমনিতেও মনুষ্য সমাজের সাথে আমার যোগাযোগটা অত্যন্ত ক্ষীণ। পরিবার, অল্প কয়েকজন বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকতার সূত্রে ছাত্রগণ—এই। অনেক দিন পর্যন্ত নিজের ব্যাপারে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। ভাবতাম আমি বুঝি খুব হইহুল্লোড়ে মানুষ। এটা সত্য—ঘনিষ্ঠ পরিবেশ ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সাক্ষাতের সময়গুলোতে, শিশুদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতে আমি কলরবমুখর থাকি। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে উচ্চকিত হই। কিন্তু সে সময়টুকুই। অন্যথায় একটা সময় গিয়ে নিজের দিন যাপনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে আমি আসলে আত্মমগ্ন এক নির্জন মানুষ।

নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মিশি শুধু তাদের সাথেই, যারা সহজ। যাদের পাশে অযথাই গিয়ে বসে থাকা যায়। যাদের কাছে গেলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় না। আমি কি তবে নিজেকে বড় ভাবতে চাই? ঠিক তা-ও নয়। কিন্তু তুচ্ছ ভাবতে চাই না। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মধ্যেই যোগ্যতা আছে, কর্মক্ষমতা ও কর্ম দক্ষতা আছে। কিছু মানুষ থাকে এমন, তারা জ্ঞানী, ভালো, সৎ; কিন্তু খুব বেশি নেতিবাচক উপদেশপ্রবণ। আপনাকে অগ্রসর করার জন্য কল্যাণকামী হয়ে অনেক মূল্যবান উপদেশ দেবেন, আন্তরিকভাবেই। এবং যে উপদেশগুলো দেবেন, তা সত্যিই উপযোগী ও দরকারি। কিন্তু উপদেশ দানের কাজটুকু করবেন আপনার দুর্বলতার সমালোচনা করে, অস্বস্তিকর গাম্ভীর্য নিয়ে। এটা আমার ভালো লাগে না কখনো।

এই উপদেশগুলো ভিতরে অনুশোচনা ও হতাশা সৃষ্টি করে এবং জীবনী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে চলার গতিকে রুদ্ধ করে দেয়। নিজেকে তখন ব্যর্থ ও নিজের কাছেই অপমানিত মনে হতে থাকে। এটা আমি কখনোই চাই না। এমন লোকজনের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা নেই। ঘৃণার তো প্রশ্নই আসে না। তাদের কল্যাণকামিতা ও ভালোবাসার জন্য সীমাহীন কৃতজ্ঞতা আছে; কিন্তু তাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলি সবসময়।

আমি অনেক বার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, হচ্ছি; কিন্তু এর বিপরীতে এমন কিছু মানুষও পেয়েছি, যাদের কাছে গেলে মন ভালো হয়ে যায়। তাদেরকে দেখলেই ভিতর থেকে একটা অমলিন ভালো লাগার হাসি উঠে এসে চোখ ঠোঁট ও চেহারার সর্বত্র মিহি দানার মতো ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যক্তিগতভাবে এসব বিষয়ে আমার দুর্বলতার শেষ নেই। কিন্তু জীবনে বারবার আহত হওয়ার পর এই দিকটাতে একটা জেদ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভিতরের কুশ্রী রূপটাকে লুকিয়ে রেখে হলেও সবসময় চেষ্টা করেছি আমি যেন এমন না হই। সবসময় পারিনি। বা বলতে গেলে বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়েছি নিজের প্রবৃত্তির কাছে; কিন্তু চেষ্টাটা জারি রাখতে চেয়েছি সবসময়।

পরিবারে আমার ছোট আছে তিনজন। এর মধ্যে বোনটাকে তো কাছে পাইনি বলতে গেলে। কিন্তু ছোট দুই ভাই মাওলানা হুজাইফা মাহমুদ ও মাওলানা আনাস চোধুরীর সাথে চলতে গিয়ে, শাসন ও তরবিয়ত করতে গিয়ে, উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে আমি লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছি, তারা যেন আমার থেকে দূরে সরে না যায়। আমাকে দেখলেই যেন বড় ভাই সুলভ অস্বস্তি ও সংকোচ সৃষ্টি না হয়। পুরোপুরি পারিনি অবশ্যই। এর জন্য আমি লজ্জিত। কিন্তু সামান্য যেটুকু পেরেছি, এর সুফল আমি পেয়েছি। আমাদের সম্পর্কটা সবসময়ই ছিল পরম বন্ধুর মতো। শ্রদ্ধা ও স্নেহ, মমতা দয়া ও কল্যাণকামিতা এবং নৈকট্য ও আপনত্বের ভিতর দিয়ে আমরা পরস্পরকে দারুণভাবে অনুভব করি। বিয়ের পর চেষ্টা করেছি স্ত্রী ও সন্তানদের সাথেও যেন এমন একটি সহজ সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। আরও একটি বড় জায়গা হলো ছাত্রদের সাথে আমার সম্পর্কটি।

আমাদের মধ্যে অনেক সময় একটা ভুল ধারণা থাকে। ভাবি, ছোটদেরকে আমরা স্নেহ করব এবং শুধু এটুকুই। তাদেরকে সম্মান করা ও সম্মান প্রদর্শনের চিন্তাটি মাথায় আসে না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এটা ভুল। ছোটদেরকেও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপার আছে। এটা অবশ্যই বড়দেরকে যেভাবে সম্মান দেখাই প্রকাশের দিক থেকে সেরকম নয়। এ হলো তার সত্তাকে সম্মান করা, তার ইচ্ছা চাহিদা রুচি ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। জোরপূর্বক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দেওয়া। এটা মৌলিকভাবে দরকারি, ব্যক্তিত্বে সহজতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, সেই সাথে ছোট মানুষটির মধ্যে যেন আত্মসম্মানবোধের চেতনাটি জাগ্রত হয় সে জন্যও একান্ত আবশ্যক। একটা শিশু বা কিশোর যদি নিজেকে সম্মানি ভাবতে না পারে, তাহলে জীবনে বড় হওয়া বা ভালো মানুষ হওয়া তার জন্য মুশকিল। সবসময় স্নেহ আর শাসনের উপর রাখলে এবং সম্মানটা না দেখালে সে একদিকে হীনম্মন্যতার শিকার হবে, অপরদিকে আমার থেকে দূরে চলে যাবে।

সমাজে সম্পর্কের অস্বস্তিটা বিশেষ কয়েকটি জায়গায় বড় প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এসবের অন্যতম হলো বড় ভাই ও ছোট ভাই, বাবা ও ছেলে, শিক্ষক ও ছাত্র, দায়িত্বশীল ও অধস্তন। এটা তরবিয়ত ও পরিচালনায় বিপুল বাধা সৃষ্টি করে। অনেকের অভিযোগ হলো শাসনের জায়গায় থাকলে অধস্তনদের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ রেখে চলা মুশকিল। আইনের প্রয়োগ ও জবাবদিহিতা আড়ষ্টতা সৃষ্টি করবেই। এটা আমি কখনোই মানতে পারি না। সম্পূর্ণ ভুল অভিযোগ মনে হয়। অনাবশ্যক গম্ভীরতা পরিহার করে অভিব্যক্তি ও শব্দচয়নে যদি বিনয়, নম্রতা এবং মমতার বিষয়টি প্রকাশিত থাকে, সম্মানটা প্রদর্শন করেন, আচরণে সহজ ও ইতিবাচক হন, তাহলে এ আড়ষ্টতা আসবে না নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ছাত্র বা ছোট ভাইটিকে উপদেশ দিতে গিয়ে চেহারাটি এমন মেঘাচ্ছন্ন হতে হবে কেন? শুধু আফসোস আর হতাশাই ঝরতে হবে কেন? কেন একনাগাড়ে আপনিই কথা বলে যাবেন? সংলাপটা কোথায়? কোথায় আপনার হাসিটা? মজা করে কথা বলাটা শুধু বন্ধুদের সাথেই? কেন আপনার উপদেশ শুনবার পর ছেলেটা মন খারাপ করে ঝিম মেরে বসে থাকবে এক জায়গায়? নব প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে প্রজাপতির মতো উড়বে না কেন?

আচরণগত বিষয়ে আমি সবসময় চোখ ফেলে রাখি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাতের উপর। তিনি কীভাবে তার পরিবার, পরিজন, সাহাবা, শিষ্যগণ ও শিশুদের সাথে জীবনযাপন করেছেন? প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের আমল দিয়ে খুব সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও নমুনা দিয়ে গেছেন সকলের জন্য। কী সহজ ছিল তার জীবনধারাটি, মানুষের সাথে তার চলাফেরা ও সম্পর্কটি। শিরোনামে আমি যে শব্দটি নিয়েছি তা তার জীবন থেকেই।

আচরণে কেমন সহজ ছিলেন, এর বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয় তিনি ছিলেন লায়্যিনুল জানিব। অর্থাৎ, পার্শ্ব নরম মানুষ। কী অসাধারণ একটি গভীর শব্দ। এটাই আদর্শ। এর বাইরে আর কোনো আদর্শ নেই। অনেক মানুষ থাকেন রুক্ষ কঠিন। মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। তাদের পাশ ঘেঁষা যায় না। সামনে থেকে উঠে আসতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যায়। তাদের লাজ রক্ষা করার জন্য আমরা বলি তিনি কিছুটা ‘জালালি তবিয়তের মানুষ’। এ কথা বলে তার আচরণটিতে একধরনের সুন্দর জামা চড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি একে শব্দের আশ্রয়ে এমন সুশোভিত করার পক্ষে নই। মানুষ ভালো হয়েও নানা দিক দিয়ে তার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। এটুকু এড়িয়ে তাকে ভালোবাসতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আদর্শ সেটাই, যেটি ছিল নবীজির। তিনি ছিলেন লায়্যিনুল জানিব—নরম কাঁধের মানুষ।
সাবের চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ