অহংকারী নেককার বনাম অনুতপ্ত পাপী

  • অহংকারী নেককার বনাম অনুতপ্ত পাপী

‘যে-ব্যক্তি তার ভাইকে পাপের জন্য লজ্জা দেয়, সে নিজে যতক্ষণ ওই পাপে নিমজ্জিত না হয়, ততক্ষণ তার মৃত্যু হবে না’। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই হাদিসটি মুআয ইবনু জাবাল রাজি.-এর বর্ণনায় ‘তিরমিজি’তে বর্ণিত হয়েছে। অধ্যায়—‘সিফাত আল-কিয়ামাহ ওয়াল-ওয়ারা’ হাদিস - ২৪২৯। ইমাম তাবরানি ও ইমাম ইবনু আবি দুনিয়াও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। 

মানুষকে তার গুনাহের জন্য হেয় করা, ছোট করা; জনসমক্ষে, প্রকাশ্যে কিংবা আকার-ইঙ্গিতে অপমান করা আজকাল আমাদের কাছে খুবই সাধারণ একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার অকল্যাণে এ-কাজটি এখন অত্যন্ত করা যায়, সে-কারণে এর সয়লাব বইছে। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা জানা আমাদের প্রয়োজন। 

উল্লিখিত হাদিসটিকে যদিও বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ইমাম আলবানি জয়িফ ও মাওযু ‘তিরমিজি’র-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন, কিন্তু হাদিসটিতে বর্ণিত বিষয়ের ওপর প্রখ্যাত অনেক বিদ্বানগণ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন। তাই হাদিসটির সনদ যতই দুর্বল হোক-না কেন; আলোচিত বিষয়বস্তু নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে এ-সকল খ্যাতিমান বিদ্বানগণ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেন না; হাদিস জয়িফ বলেই ছেড়ে দিতেন। আসুন জেনে নিই, তারা কে কী বলেছেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়িম এ-প্রসঙ্গে বলেন,
‘হাদিসটির ব্যাখ্যা এমনও হতে পারে, পাপ করে ফেলা ব্যক্তিকে কটাক্ষ করা, হেয় করা, ছোট করার অপরাধটা কখনো কখনো খোদ সেই পাপ কাজের চেয়েও বড় পাপ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অন্যকে পাপের কারণে এভাবে হেয় করার পরোক্ষ অর্থ দাঁড়ায় যে, অপমানকারী নিজের ইবাদত-বন্দেগি নিয়ে বেশ গর্বিত, নিজের পাপহীনতার অহংবোধ তাকে বেশ ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে; তাই তো সে তার অপর কোনো মুসলিমের পাপে নিমজ্জিত হওয়ার বিপরীতে নিজেকে শুদ্ধ ও পবিত্র দাবি করছে। 

কিংবা এমনও হতে পারে—পাপ করে ফেলা ব্যক্তি তার পাপ নিয়ে আল্লাহর কাছে লজ্জিত ও অনুতপ্ত; পাপবোধ থেকে তার ভেতরে নিজেকে তুচ্ছ মনে করার বৈশিষ্ট এসেছে; তার মধ্যে নম্রতা সৃষ্টি হয়েছে, নিজেকে অন্যের চেয়ে সে মন্দ ভাবছে। হতে পারে নিজেকে সেই পাপ থেকে দ্রুত বের করে আনার তাগিদই তার মধ্য থেকে অহংবোধ দূর করে দিচ্ছে, আত্মগরিমা থেকে দূরে রাখছে; হতে পারে পাপ থেকে সৃষ্ট অপরাধবোধ থাকার কারণে ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে আল্লাহর সামনে মাথা নিচু করে সে দাঁড়াতে পারছে। 

বিপরীতে ইবাদতের অহংকার, নেক-আমলের সূক্ষ্ম দম্ভ, অনেক নেক কাজ করে ফেলার আত্মতৃপ্তি, নিজেকে আল্লাহ ও মানুষের কাছে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করার চেয়ে সেই পাপী ব্যক্তির অপরাধবোধ ও অনুশোচনা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি প্রিয় এবং তার জন্য অনেক কল্যাণকর। 

এ-ধরনের পাপী ব্যক্তি আল্লাহর রহমতের কত সন্নিকটে আছে এবং আর এই পাপহীনতার অহংকারে ডুবে থাকা ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধের কত নিকটে রয়েছে, তা বলে বোঝানো যাবে না! যে-পাপ কোনো ব্যক্তিকে তওবা-ইসতেগ্‌ফার, অনুতাপ ও অনুশোচনার দিকে নিয়ে যায়; সেটি আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তির নেক আমলের চেয়ে অনেক প্রিয়—যে তার নেক আমল ও ভালোমানুষিতা নিয়ে অহংকার করেও পরিতৃপ্তিতে ভোগে।
 
আপনি যদি তাহাজ্জুদ না পড়ে সারা রাত ঘুমান, আর রাত জাগতে না-পারার অনুশোচনা অনুভব করেন, নিজেকে তুচ্ছ ভাবেন; তা আপনার জন্য সেই ব্যক্তির রাত জেগে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম হতে পারে; যে নামাজ পড়ে নিজেকে অনেক উত্তম মানুষ মনে করে আত্ম-প্রশংসায় ভরা অন্তর নিয়ে সকালে জেগে ওঠে। কারণ যে নিজেকে উত্তম মনে করে, তার আমল কবুল হয় না। শুদ্ধতার গর্বে অহংকারী ব্যক্তির তসবিহ পাঠের চেয়ে পাপীদের হৃদয়ভাঙা আর্তনাদ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। 

হতে পারে কোনো ব্যক্তির কৃত পাপের মধ্যে আল্লাহ তার অন্তরের আরও কোনো ভয়ানক ব্যাধি দূর করার মহৌষধ রেখেছেন। এই ব্যাধি সূক্ষ্মভাবে হয়তো আপনার মধ্যেও আরও ভয়ানকভাবে আছে; অথচ আপনি তার খবরও রাখেন না! কী ভয়ংকর ব্যাপার!

পাপী ব্যক্তি এবং পাপহীন ব্যক্তি উভয়ের সাথেই যা ঘটে, তার পেছনে আল্লাহর এমন কোনো হিকমাহ নিহিত থাকে; যা তিনি ছাড়া আর কেউই জানেন না। আর এই সূক্ষ্ম বাস্তবতা কেবল গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারে এবং তা-ও কেবল মানবীয় সীমাবদ্ধতার মধ্যেই। এমনকি মানুষের পাপপুণ্যের হিসাব ও পরিণতির মধ্যে অনেক এমন গোপন কারণও রয়েছে, যা আমল লেখার কাজে নিয়োজিত ফেরেশতারাও জানে না। 

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের কারও দাসী যদি ব্যভিচার করে, তবে সে তাকে শাস্তি প্রদান করুক, কিন্তু তার সমালোচনা যেন না করে।’

শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া যাবে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপমান, চরিত্র হনন কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে না; এমনটা করার কোনো অনুমতি বা দায়িত্ব আল্লাহ আমাদের কাউকে দেননি। [মাদারিজুস সালিকিন ১/১৭৭, ১৭৮]

হাদিসটির সরল অর্থের বিষয়ে শাইখ আল মুবারকপুরী বলেছেন—ইমাম আহমাদ যেভাবে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন, তা হলো—এখানে ‘যে ব্যক্তি লজ্জা দেয়’ বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যে কোনো পাপের কারণে কাউকে নিন্দা বা ছোট করে। 

‘তার ভাইকে’ বলতে বোঝানো হয়েছে তার কোনো ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ ভাই কে, অর্থাৎ কোনো মুসলিমকে।

‘কোন পাপ’ বলতে ইমাম আহমাদের মত অনুযায়ী—এমন পাপ, যা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হয়তো তওবা করেছে।

‘ততক্ষণ তার মৃত্যু হবে না’ এর ‘সে’ হলো সেই ব্যক্তি যে অন্যকে পাপের কারণে হেয় করেছে। 

‘যতক্ষণ না সে তা করে’ অর্থ হলো যে পাপের কারণে সে মুসলিম ভাইকে হেয় করেছে সে নিজেও সেই পাপে নিমজ্জিত হবে। ব্যাপারটা এমন- যেন আল্লাহ তাকে পরিত্যাগ করবেন যতক্ষণ না সে সেই পাপে নিমজ্জিত হয়। 

কেউ কেউ এমন আছে, যারা পাপ করে ফেলে কিন্তু তা গোপনে, প্রকাশ্যে করে না। এমন কারও গোপন পাপের কথা কেউ যদি জেনে ফেলে, তাদের প্রতি উপদেশ হলো, সে যেন তার মুসলিম ভাইয়ের পাপের কথা গোপন রাখে, ব্যক্তিগতভাবে তাকে উত্তমভাবে নসিহত করে; কোনো অবস্থাতেই সে যেন তার ভাইয়ের গোপন পাপের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ না করে।
[তুহফাতুল আহ্ওয়াদি ৭/১৭৩]

মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। বিষয়টি জেনে বুঝে নিজের জীবনে সফলভাবে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন।

সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ