অসিশপ্ত : লেখক সুমিত বর্ধন | Ovishopto By Sumit Bordhon

  • বই : অসিশপ্ত
  • লেখক : সুমিত বর্ধন
  • প্রকাশক : কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস 
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩০০টাকা
  • রিভিউ ক্রেডিট : কৌশিক রায়


কল্পনার ডানা মেলে একজন লেখক ঠিক কতটা অলীক স্বপ্নকেও যে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনতে পারেন, তা এ বই না পড়লে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। মূল গল্পের বিন্যাস রচিত হয়েছে 'অম্বলিকা' নামক এক কল্পিত গ্রহে। সেই গ্রহে কোনও এক প্রাচীনকালে 'ভিন্নর' নামের উন্নত জীবেরা বাস করত। বিশৃঙ্খলাতার পথ ধরে তারা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের ফেলে রেখে যাওয়া প্ৰযুক্তি ও স্থাপত্যকে সম্বল করে সেখানে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলে। অম্বলিকার পরিবেশ মানুষের মননে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

গল্পের 'অন্যতম' মূল চরিত্র রজত অম্বলিকার বিপদের সামনে পড়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। তাকে প্রকৃত পুরুষ হিসাবে গড়ে তুলতে তার পিতা তাকে পাঠান অসি-শিক্ষাকেন্দ্রে। সেখানেও রজত সবার কাছে বিদ্রুপের পাত্র হতে থাকে। হঠাৎই একদিন সে পায় 'ভিন্নর'দের ছেড়ে যাওয়া কিছু বা হয়তো 'কিছু' পায় তাকে। তারপর থেকেই রজত হয়ে ওঠে রক্তপিপাসু, হিংস্র ও বিধ্বংসী। অসি হাতে সে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। তার মধ্যে থেকে হারিয়ে যেতে থাকে মায়া, মমতার মতো মানবিক গুণগুলো। এই কাহিনির সঙ্গে মিতা, রবি, রিমা, অতীন, হিমু এদের জীবনেও আবর্তিত হতে থাকে দৌলতনগর, ইউলারগঞ্জ, হকিন্সাবাদ হয়ে অম্বলিকার বিভিন্ন জায়গায়।

এই উপন্যাসের অন্যতম ভালো ব্যাপার হল মূলত দুটো। ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ও ভাষা সৌকর্য। লেখক খুব নিপুণহাতে প্রত্যেকটি দৃশ্যকে পাঠকের মনের চোখে ভাস্বর করে তুলেছেন। একটা অচেনা জগৎতের রূপ-রস-গন্ধ অক্ষরের মাধ্যমে এমন নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা পাঠককে অন্য এক জগৎ-এ নিয়ে যায়। কাহিনির খাতিরে লেখক বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা বুঝতে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু পড়ার সময় মনে হয় ওই একটি মাত্র শব্দই বোধহয় গোটা দৃশ্যকে আলাদা একটা মাত্রা দান করেছে। লেখকের একটি ছোট গল্প বছর দুই আগে একটি পুজো সংখ্যায় পড়েছিলাম। তখনও এই একটি জিনিস আমায় মুগ্ধ করেছিল- শব্দ চয়ন।

এই কাহিনিতে আরও যুক্ত হয়েছে জাপানি অসিবিদ্যার খুঁটিনাটি, বিভিন্ন কৌশল। তা এই কাহিনির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ইদানিং-এর মধ্যে এই ঘরনার বাংলায় কোনও বই আমি অন্তত পড়িনি। তাই অল্প কথায় জাপানি অসির মতোই ধারালো এই কাহিনি মনে দাগ রেখে যাবে বহুদিন।

সবশেষে একটা অভাববোধের কথাও বলি। কাহিনির গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী দেখলে রজতকে কেন্দ্র করে এক কল্পিত গ্রহের অরাজক সময়ে কিছু মানুষের গল্প এই উপন্যাস। আমরা যারা অনেকেই ফ্যান্টাসি পড়তে আগ্রহী তাদের কাছে এ বই নিঃসন্দেহে এক 'দারুন ব্যাপার'! কিন্তু যারা হয়তো সেভাবে ফ্যান্টাসির সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের কাছে গল্পের নির্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে সেই অর্থে সেভাবে কোনও 'সেন্ট্রাল ক্রাইসিস' নেই। ফলে অনেক পাঠকদের পড়তে পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়। এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য 'দৃশ্যায়ন', কোনও একমুখী 'গল্প' নয়। ফলে এই একটা অভাব বোধ মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে। 


তবে ফ্যান্টাসি প্রিয় পাঠকদের এ বই একবার অবশ্যই পড়া উচিৎ বলে আমার অন্তত মনে হয়েছে। যে পরিমাণ যত্ন ও ভালোবাসায় একটি গোটা জগৎ গড়া হয়েছে তাতে লেখককে কুর্নিশ জানাতে হয়। কল্পবিশ্বের প্রোডাকশন বরাবরের মতোই ভালো। ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য, অদ্রীজা ও সুমিত বর্ধনের অলংকরণ, ম্যাপ, প্রচ্ছদ এই বইকে মারকাটারি করে দিয়েছে। তাঁদেরও সাধুবাদ অবশ্য প্রাপ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ