আমার জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত যে, আমি আপনাদের সামনে আলোচনা করার সুযোগ পাচ্ছি। আমার এ আনন্দ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে যখন জেনেছি যে, এখানে যারা উপস্থিত আছেন তারা নিজেদের ব্যবসাকে শরীয়তের আদলে গড়ে তোলার চিন্তা ও সংকল্প নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।
আজকাল সভা-সম্মেলন তো অনেক হয়। বক্তৃতা-বিবৃতিও হয় প্রচুর। কিন্তু সেই সভা, সম্মেলন, বক্তৃতা ও বয়ান আমাদের বাস্তব জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন সাধন করে না। এর এক কারণ, সেগুলো ‘বসলাম, বললাম এবং চলে গেলাম’ এই গতানুগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
কিন্তু শ্রদ্ধেয় জনাব রফিক আহমদ সাহেব এইমাত্র যে কথাটি বললেন তাতে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমরা এ সংকল্প নিয়ে এই মাহফিলে সমবেত হয়েছি যে, আমরা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমাদের জীবনযাত্রাকে শরীয়তের আদলে ঢেলে সাজানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করব। যেসব নির্দেশনা এখানে আমরা লাভ করব তা শোনার পর এখান থেকে আমরা এ অঙ্গীকার নিয়ে উঠব যে, এখন থেকে আমরা সম্পূর্ণ নতুন মানুষ।’
কত বড় কথাই না তিনি বললেন! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন!
মুসলমানের গোটা জীবনই হতে পারে পুণ্যময়
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর ফযল ও করমে আমাদেরকে এমন দ্বীন দান করেছেন, যার মধ্যে মানবীয় প্রয়োজনের কোনো দিককেই অবহেলা বা উপেক্ষা করা হয়নি। আপনারা জেনে থাকবেন, কুরআনে কারীম পৃথিবীতে মানব সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছে তা হল-
وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الْاِنْسَ اِلَّا لِیَعْبُدُوْنِ
আল্লাহ তাআলা বলছেন, আমি মানুষ এবং জিনকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। তারা আমার ইবাদত করবে- কেবল এ উদ্দেশ্যেই তাদের সৃষ্টি করেছি। [সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৬]
তো মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্যই যখন এই, তখন কর্তব্য ছিল, সকাল-সন্ধ্যা, দিবারাত্রি মানুষের আর কোনো কাজ থাকবে না; শুধু আল্লাহর ইবাদত করবে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর অসীম অনুগ্রহে মানুষ সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও তাকে তার মানবীয় প্রয়োজন পূরণ করারও অনুমতি দিয়েছেন। অর্থাৎ সে নিজের ও পরিবার-পরিজনের জীবনোপকরণ এবং বসবাসের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
এ কারণে আল্লাহ তাআলা এমন এক দ্বীন আমাদেরকে দান করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারি। শুধু প্রয়োজন পূরণ পর্যন্তই শেষ নয়, বরং এগুলোকে নেক আমলেও পরিণত করতে পারি।
আল্লাহর নৈকট্য
পৃথিবীতে অনেক ধর্ম এমন আছে, যার দৃষ্টিভঙ্গি হল, আল্লাহ তাআলাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পাবেন না অর্থাৎ তাঁর নৈকট্য-সন্তুষ্টি লাভ করবেন না, যতক্ষণ না আপনি দুনিয়ার সকল কর্মব্যস্ততা ত্যাগ করে আশ্রম-উপাসনালয়ে গিয়ে ঠাঁই নিবেন এবং নির্জন সাধনার জীবন গ্রহণ করবেন। বহু ধর্ম এমন আছে, যার বক্তব্য হল- দ্বীন এবং দুনিয়া একসঙ্গে চলতে পারে না।
আপনারা তো এমন এক দেশে (ভারতে) বসবাস করেন যেখানে অবশ্যই আপনারা দেখেছেন অথবা শুনেছেন যে, অনেক মানুষ আত্মসংযম ও আত্মপীড়নের নানাবিধ আচার-সংস্কার পালন করে এ ধারণা করছে যে, আমরা খোদার প্রিয়ভাজন হয়ে গেছি। তারা কেমন সব কষ্ট-সাধনা করে। উপবাস থেকে দিন কাটায়। উদোম-উলঙ্গ হয়ে সময় যাপন করে। নিঃশ্বাস অবরুদ্ধ করে করে আত্মদমনের তপস্যা করে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন এক দ্বীন দান করেছেন, যার মধ্যে যদিও জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ইবাদত বলা হয়েছে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সব কায়-কারবার ছেড়ে দিয়ে বসে যাও। বরং এমন এক আদর্শ আমাদেরকে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে জীবনের নানাবিধ প্রয়োজনও পূরণে বাধা থাকে না, আয়-উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই গতিশীল থাকে। শুধু যে গতিশীল থাকে এমন নয়; বরং ব্যবসা একটি নেক আমলের রূপ লাভ করে।
সৎ ব্যবসায়ীদের হাশর হবে নবীগণ ও সিদ্দীকীনের সাথে
ছোট্ট একটি বিষয়, যার প্রতি যত্নবান হলে সকল কারবার নেক আমলে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সেটা হল, আল্লাহ তাআলা কিছু বিষয় হালাল করেছেন আর কিছুকে হারাম। তন্মধ্যে হারামকে ছেড়ে হালালকে গ্রহণ করা। পাশাপাশি একথাও বলে দিয়েছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ اَمْوَالُكُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ
তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের সন্তান যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে না দেয়। -সূরা মুনাফিকুন (৬৩) : ৯
এটা হতে পারবে না যে, ব্যবসায় মত্ত হয়ে আপন দ্বীনী কর্তব্য ভুলে যাবে। আল্লাহ তাআলাকে মনে রাখবে না। বরং তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহকে স্মরণ রাখা এবং হালাল পদ্ধতিতে আয় উপার্জনের চেষ্টা করা। হাদীস শরীফে এসেছে-
التّاجِرُ الصّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشّهَدَاءِ
সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবীগণ, সিদ্দীকীন এবং শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১২০৯
ইমাম বুখারী রাহ.-এর ব্যবসা
ইমাম বুখারী রাহ., যার কিতাব বুখারী শরীফ অত্যন্ত বিখ্যাত এবং أصح الكتب بعد كتاب الله পরিচয়ে অভিহিত, তিনিও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ব্যবসার অঙ্গনে-
التّاجِرُ الصَدُوقُ الأَمِينُ
‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী’-এর এক আদর্শ নমুনা বানিয়েছিলেন।
ইতিহাসে তাঁর সম্পর্কে আছে যে, একবার কিছু লোক তাঁর কাছে এসে কোনো একটি পণ্যের সওদা করে চলে যায়। হযরত ইমাম বুখারী রাহ. মনে মনে ঠিক করলেন, এ পণ্যটির বিক্রয়মূল্য পাঁচ হাজার দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ধার্য করব। তিনি এখনো এ বিষয়ে কোনো চুক্তি বা লেনদেন করেননি। শুধুই অন্তরে নিয়ত করেছিলেন। কিন্তু ঐ লোকদের আসতে দেরি হচ্ছিল। সম্ভবত দুয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও তারা আসল না। ইতিমধ্যে নতুন একদল গ্রাহক এসে সেই পণ্যটিই দশ হাজার দিরহাম মূল্যে কিনতে চাইল। ইমাম বুখারী রাহ. বললেন, আমার কাছে আগে একদল গ্রাহক এসেছিলেন। আমি তাদেরকে এটি পাঁচ হাজার দিরহামে দিব বলে নিয়ত করেছিলাম। তাই এখন এটা আপনাকে বিক্রি করতে পারব না। তারা বলল, এখনো তো আপনার লেনদেন পূর্ণ হয়নি!
তখন ইমাম বুখারী রাহ. উত্তর দিলেন, লেনদেন বা চুক্তি হয়নি সত্য, কিন্তু আমি মনে মনে স্থির করে নিয়েছিলাম যে, পাঁচ হাজার দিরহামে তাকে এটি দিয়ে দিব। তাই দশ হাজার দিরহামে এটি তোমাকে দিতে আমার মন আগাচ্ছে না। এভাবে তিনি এ দশ হাজার দিরহামের প্রস্তাবটি বাতিল করে দিলেন। তারপর যখন সেই প্রথম দল আসল, তখন তাদের কাছে পাঁচ হাজার দিরহামেই জিনিসটি বিক্রি করলেন। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৪৮০)
সহীহ বুখারীর আরো একটি ঘটনা
এ ইমাম বুখারী রাহ.-ই তাঁর কিতাব বুখারী শরীফে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, জনৈক ব্যক্তি একজন লোকের কাছে জমি বিক্রি করল। জমিটির খরিদ্দার যখন তাতে খোঁড়াখুঁড়ি করছিল তখন ঘটনাক্রমে সেখানে স্বর্ণমুদ্রায় ভর্তি একটি কলসি বেরিয়ে আসল।
কলসিটি নিয়ে লোকটি জমি বিক্রেতার কাছে এসে বলল, ভাই, তোমার জমিতে এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো পেলাম। তাই এগুলো তোমার। কারণ, আমি তো তোমার কাছ থেকে শুধু জমি কিনেছি, স্বর্ণ কিনিনি। উত্তরে জমি-বিক্রেতা বলল, এটা আমি নেব না। কেননা, আমি যখন জমি বিক্রি করেছি, তখন তার মধ্যে যা ছিল সেটাও তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছি। এবার দু’জনের মাঝে উল্টো ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। একজন বলে, নাও। অন্যজন বলে, নেব না।
এমনকি বিষয়টি একপর্যায়ে কাজীর দরবার পর্যন্ত চলে গেল। এবং পুরো ঘটনা তাকে জানানো হল। সবকিছু শুনে কাজী সাহেব ফায়সালা করলেন যে, তোমাদের দু’জনের কোনো ছেলে-মেয়ে আছে? সৌভাগ্যক্রমে দেখা গেল, একজনের একটি ছেলে আছে। আর অন্যজনের একটি মেয়ে আছে। কাজী সাহেব তখন বললেন, তোমার ছেলের কাছে তোমার মেয়েকে বিয়ে দাও। আর এ স্বর্ণগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করো। এভাবেই এ ঝগড়ার অবসান হয়। -সহীহ বুখারী,হাদীস ৩৪৭২
ব্যবসা একটি নেক আমল
মোটকথা ব্যবসা যখন আমানতদারী, বিশ্বস্ততা এবং সততার সঙ্গে করা হবে তখন এটি নেক আমলে পরিণত হবে। দোজাহানের সর্দার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ব্যবসা করেছেন এবং ব্যাপক পরিসরে করেছেন। যাকে আজকাল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড (International trade) বলা হয়। এ অঙ্গনে তিনি আমাদের জন্য অনেক আদর্শ রেখে গেছেন। যদি ঈমানদারি, আমানত ও সততা আমাদের মাঝে এসে যায় তবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড গুলো নেক আমলে পরিণত হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
-জাস্টিস আল্লামা তাকি উসমানী
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....