- কী হলো মামা, এমন কর্যা হ্যাসতে ল্যাগাছো ক্যানে?
- ওহ মামা, এমন একটা সিরিজ পড়ছি যেটা পড়লে হাসি থামানো যায় না!
- তাই নাখি? জব্বর বই নাখি মামা?
- জব্বর বলে জব্বর – এর চেয়ে জব্বর বোধ হয় আর হয় না। টেরি প্র্যাচেটের ডিস্ক ওঅর্ল্ড সিরিজ পড়ছি। ইনি এমন এক লেখক যিনি ফ্যান্টাসি লেখা শুরুই করেছেন ফ্যান্টাসিতে হাস্যরস আনার জন্য। ইনার ডিস্ক ওঅর্ল্ডের মত এত হাসির আর মজার ফ্যান্টাসি আর হয় না। এই সিরিজে টেরি প্র্যাচেট সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারা তৈরি করেছেন।
- তাই নাখি? তা অখে লিয়্যা কিছু বুলো তো শুনি।
- প্র্যাচেট ডিস্ক ওঅর্ল্ডের প্রথম বইটা লেখেন ১৯৮৪ সালে। উনি ফ্যান্টাসির বড় একজন ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তখনকার ফ্যান্টাসি গল্পগুলো খুব গুরুগম্ভীর আর এগুলোতে “ট্যু ম্যানি ডার্ক লর্ডস, ট্যু মাচ ল্যাক অব থটস” ছিলো বলে এর প্রতিবাদ হিসেবে প্র্যাচেট কালার অব ম্যাজিক বইটা লেখেন। সেই শুরু। এর পর একের পর এক তুমুল জনপ্রিয় বই লিখে গেছেন। উনার লেখা এতটাই মজার যে দুয়েকটা উদাহরণ দিই শোনো।
- হ্যাঁ, বুলো।
- এই যে একটা – “অনেক জলদস্যু অমর হয়ে রয়েছে তাদের দুঃসাহসী কাজ-কর্ম বা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার জন্য। কেউ কেউ অমর হয়েছে বিপুল ধন সম্পদের মালিক হয়ে। কিন্তু অনেক আগেই ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি অমর হয়ে রইবেন – বেঁচে থেকে!”
- হি হি হি, জব্বর কথা বুইলছে তো!
- হ্যাঁ! আর এই যে আরেকটা শোনো। “আমার নাম এখানে ব্যপার না” সে বললো। “বাহ! খুব সুন্দর নাম তো - এখানে ব্যপার না! অন্য রকম নাম” রিন্সউইন্ড জবাব দিলো।
- হো হো হো। মাম্মা, এই মামুর বুটা তো এখখেবারে ফাট্যায়ে দিয়্যাছে গো!
- হ্যাঁ। ঠিকই বলেছো। টেরি প্র্যাচেটের লেখা নিয়ে তাই তো স্বয়ং ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সন বলেছেন উনার সাথে তুলনা দেয়া যেতে পারে একমাত্র শেক্সপীয়ারের।
- অ্যাহ!
- আরে বদ্দার মতো চেতি গেসো নাকি মামা? চেইতো না। সত্যি সত্যিই স্যান্ডার্সন বলেছেন “The closest thing to Pratchett out there is Shakespeare. Yes, really.”
- বুললেই হলো? যা তা কেউ না, এক্ষেবারে শেক্সপীয়ার?
- মামা, স্যান্ডার্সনের মত একজন লেখক যখন অন্য একজনের সম্পর্কে এরকম কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে এর পেছনে বস্তুনিষ্ঠ কারণ আছে। আচ্ছা এসো, তোমাকে প্র্যাচেটের লেখা আর ডিস্ক ওঅর্ল্ড সম্পর্কে বলি।
- হ্যাঁ, বুলো, বুলো। তবে কিনা এমুন কর্যা বুলো য্যান প্যাচতে পারি, ঠিক আছে?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ – বুঝতে পারবে এমন ভাবেই বলছি। প্রথমে আসি সিরিজের কথায়। ডিস্ক ওঅর্ল্ড সিরিজে মোট বই আছে একচল্লিশটা।
- কী-ই? কী বুলছো গো মামা, এ আবার কাখে ল্যাড়তে কাখ্যে ল্যাড়াছে! এত্তগুলা বই লিখ্যাছে! সব গুলা পড়্যা ঘটনা প্যাচতে গেলে তো কিরিবিল্টি ল্যাগে য্যাবে হেনি!
- আরে নারে মামা। আগে পুরোটা তো শোনো।
- আচ্ছা, বুইলতে থাকো, আর প্যাচাল প্যাড়বো না।
- প্র্যাচেটের ডিস্ক ওঅর্ল্ড সিরিজে একচল্লিশটা বই থাকলেও সিরিজটাতে কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র বা ভিলেন নেই। এমনকি সিরিজটার প্রায় সব বই একক বই হিসেবে পড়া যায়। আরো জব্বর ব্যাপার হচ্ছে এমনকি বইগুলোর যে “এপিসোড”গুলো আছে, সেগুলোও একটার পর একটা না পড়লে চলে। যে কোন একটা এপিসোড পড়ো, ওটাকে আলাদা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্প বলে মনে হবে। এটা এমন একটা সিরিজ না যেখানে একচল্লিশটা বই ধরে একটা মূল ঘটনারই বিভিন্ন আঁক-বাঁক আর ছোটখাটো পার্শ্ব ঘটনার (সাব প্লট) বর্ণনা আছে। সুতরাং তুমি যে কোন একটা বই ধরে শুরু করো, বুঝতে সমস্যা হবে না। কিন্তু আবার তুমি যদি একই চরিত্রগুলোকে নিয়ে লেখা বইগুলোকে পরপর পড়ো, ধরো আনসীন ইউনিভার্সিটি যে বইগুলোতে আছে সেগুলো কিংবা উইচদের বইগুলো পড়ো, তাহলে আবার দেখবে এই আলাদা আলাদা গল্পগুলো একসাথে মিলে সুন্দর একটা ঘটনাক্রম তৈরি করেছে, আবার চরিত্রগুলোর গভীরতা, তাদের চরিত্রিক পূর্ণতাও (ক্যারেক্টার আর্ক) খুব দারুনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই যে, এই ছবিটা দেখো (পোস্টের সাথের ছবি)। অন্তর্জাল থেকে পেয়েছি। এখানে ডিস্ক ওঅর্ল্ডের বইগুলোর ভেতরে সাব সিরিজগুলো আছে, সেগুলো সহ রিডিং অর্ডার দেয়া আছে।
- আরেব্বাসরে! মাম্মা তো জবের জিনিস কর্যাছে তাইলে!
- তাই তো! আরো একটা ব্যপার হচ্ছে, ডিস্ক ওঅর্ল্ড মূলত ফ্যান্টাসি ঘরানার হলেও এর ভেতরেও কিন্তু অন্য ঘরানা ঢুকানো আছে। হ্যাঁ, তোমার ভ্রু উপরে তোলা দেখেই বুঝতে পারছি তুমি কী ভাবছো। ফ্যান্টাসির মধ্যে অন্য ধারা কিভাবে আসে, তাই তো? যেমন ধরো যে বইগুলোতে কমান্ডার ভাইমস আছে, সেগুলোকে তুমি অপরাধ বা ক্রাইম ধারায় ফেলতে পারো। ডেথ বা মৃত্যু যে বইগুলোতে আছে, সেগুলোকে তুমি দর্শনের ধারায় ফেলতে পারো – যেখানে মানবচরিত্র খুব সুন্দর করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
- সেট্যা হলে সবগুলাখে আবার তুমার ওই ফ্যান্টাসি না কি ওডা বুলছে ক্যানে?
- ওহ! তোমাকে তো ডিস্ক ওঅর্ল্ডের ব্যপারেই বলা হয়নি! মামা, ডিস্ক ওঅর্ল্ডের পৃথিবীটা কিন্তু গোলাকার নয় – চ্যাপ্টা! চ্যাপ্টা একটা থালার মতো। এই চ্যাপ্টা থালাটা আছে চারটা বড় বড় হাতির পিঠে। আর এই হাতিগুলো আবার আছে একটা বিশাল কচ্ছপের পিঠের উপরে!
- কী বুইলছো মামা। এ জিনিস তো লোখে মানতো অনেক বচ্ছর আগে!
- হ্যাঁ, আর সেটাকেই স্যাটায়ার করে প্র্যাচেট তৈরি করেছেন ডিস্ক ওঅর্ল্ড। এই চ্যাপ্টা জগতে জাদুকর আছে, বামনরা আছে, ট্রল আছে, ড্র্যাগন আছে। মানুষ তো আছেই। এদের সবাইকে প্র্যাচেট এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, এতই সুন্দর করে এই জগৎটা তৈরি করেছেন যে সবাই টোকিয়েনের পরেই তাঁর ওঅর্ল্ড বিল্ডিঙের কথা বলে। কিন্তু শুধু সেটাই না। দারুনভাবে ওঅর্ল্ড বিল্ডিং অনেক লেখকই করেছেন। কিন্তু প্র্যাচেট এটা করেছেন হিউমার আর স্যাটায়ার দিয়ে! চিন্তা করো, ওঁর ডিস্ক ওঅর্ল্ডের ধারণাটাই তো প্রাচীন পৃথিবীর মানুষের চিন্তা ভাবনার একটা স্যাটায়ার। আরো মজা আছে। বিগ ব্যাং থিয়োরির কথা তো জানো? আমাদের এই মহাবিশ্ব একটা বিশাল বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে বলে বিগ ব্যাং? ডিস্ক ওঅর্ল্ডের বিগ ব্যাং কী জানো? ডিস্ক ওঅর্ল্ডের পৃথিবীটা যে কচ্ছপের উপরে আছে, সে রকম আরো অনেক কচ্ছপ আছে ডিস্ক ওঅর্ল্ডের মহাবিশ্বে। তারা সবাই মহাশূণ্যে সাঁতার কেটে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যাচ্ছে। যখন সেই জায়গায় সব কচ্ছপ পৌঁছুবে, তখন তারা সেখানে অল্প সময়ের জন্য উন্মত্ত যৌ*ন*মিলনে মিলিত হবে। এই তুমুল মিলনের ফলে যে নতুন কচ্ছপগুলোর জন্ম হবে, তারা পিঠে করে নতুন পৃথিবী নিয়ে আবার পরিক্রমায় বের হয়ে পড়বে। এই ঘটনাটাকে বলা হচ্ছে বিগ ব্যাং হাইপোথিসিস, ব্যাংগিং শব্দটার অন্য একটা অর্থ থেকে নেয়া হয়েছে। দেখেছো, আমাদের মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং হাইপোথিসিসের একেবার "মায়েরে বাপ" করে দিয়ে কী দুর্দান্ত একটা স্যাটায়ার করেছেন টেরি প্র্যাচেট?
-হি হি হি, জব্বের লিখ্যাছে তো মামু!
- জব্বের বলে জব্বের, এক্কেবারে কঠঠিন, তাই না? এর পরে ডিস্ক ওঅর্ল্ডের পাতায় পাতায় তুমি বিভিন্ন মিথোলজি, বিখ্যাত লেখকের গল্পের উদাহরণ পাবে। কিন্তু সেগুলো সব প্র্যাচেট এনেছেন এমন রসিকতার সাথে যে হাসতে হাসতে তোমার পেটে খিল ধরে যাবে। যেমন ধরো কিং আর্থারের তলোয়ারের কাহিনি। যদি তুমি দেখো একটা ম্যাজিকাল তলোয়ার পাথরের মধ্যে গাঁথা, তা হলে তুমি বুঝতেই পারছো এটা সেই বিখ্যাত কাহিনির সুত্র। কিন্তু ঠিক তখনই যদি এই যাদুর তলোয়ার কথা বলতে থাকে, আর চরম ভীতু, পলায়নপর এক জাদুকরকে বাধ্য করে এই তলোয়ার তুলতে, তাহলে কেমঅন মজা লাগবে? এমনিভাবে বইয়ে সিন্ডারেলা (উইচেস অ্যাব্রড ) কিংবা ফ্যান্টম অব দি অপেরা (মাসকিউরেড) থেকে স্যাটায়ার উঠে এসেছে। আবার কোন কোন বইয়ে প্র্যাচেট আমাদের পৃথিবীর কোন একটা জিনিস নিয়ে মজা করেছেন। যেমন “মেকিং মানি” বইয়ে বাণিজ্যিক জগৎ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ে স্যাটায়ার করেছেন। “সৌল মিউজিক” বইয়ে রক সঙ্গীত আর খ্যাতির পেছনে ছোটার ইঁদুরদৌড়কে তুলোধোনা ধুনেছেন।
কিন্তু সবার উপরে বলতে হবে টেরি প্র্যাচেটের লেখনীর কথা। উনার লেখার ধরনটাই এমন যে তোমাকে পড়তে হবে না, লেখাই তোমাকে পড়িয়ে নেবে। মনে রেখো বেশিরভাগ বইয়েই কিন্তু চ্যাপ্টার নেই – অথচ তোমার পড়তে বিন্দু মাত্রও কষ্ট হবে না। এতই দুর্দান্ত উনার লেখার ফ্লো যে যে একটার পর আরেকটা ঘটনা মনে হবে তোমার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে! আর প্লট বিল্ডিং! এমনভাবে তোমাকে কাহিনির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রাখবে যে তোমার খালি মনে হবে এর পরে কী, এর পরে কী!
এর সাথে যোগ করো পরতে পরতে চাতুর্যপূর্ণ রসালো উক্তি। শুরুতেই যেরকম বললাম, সেরকম। এখানেই শেষ নয়, এর উপরে আছে প্র্যাচেটের তীক্ষ্ণ মর্মভেদী বিবরণ। সব মিলিয়ে যে কোন মহৎ সাহিত্য যেমন হয়, প্র্যাচেটের লেখাও তেমন। কিন্তু প্র্যাচেটের লেখা আমাদেরকে ভাবায়, পৃথিবীটাকে অন্যরকমভাবে দেখতে শেখায়, আবার একইসাথে আমাদের হাসিয়েও মারে!
লেখার ধরনের পাশাপাশি লেখার সৌন্দর্যও একটা বড় ব্যপার। প্র্যাচেটের লেখা তো নয়, যেন কবিতা আর গান একসঙ্গে! শব্দ ব্যবহারে উনার নৈপূণ্য বর্ণনাতীত। এমন ভাবে পান ব্যবহার করেছেন যে …
- পান? পান ব্যভার কইর্যাছে মানে অরা পান খ্যায়া মুখ টুখ লাল কর্যা ফ্যালাছে নাখি?
- আরে নারে মামা – কিযে বলো না। এই পান মানে বাংলার পান না, ইংরেজীর পি-ইউ-এন। মানে, আচ্ছা মানে বোঝানোর চেয়ে একটা উদাহরণ দেই। ডিস্ক ওঅর্ল্ডের কথা বললাম না যে এটা একটা চ্যাপ্টা থালার মত। তাহলে থালার তো একটা কিনারা আছে, নাকি? ইংরেজীতে বৃত্তের এই কিনারা বা বেড়কে সারকামফিয়ারেন্স (circumference) বলে। এখন এই যে ডিস্ক ওঅর্ল্ডের যে কিনারা আছে, সেই কিনারা বরাবর দড়ি দিয়ে একটা বেড়া বা ফেন্স (fence) দেয়া আছে। প্র্যাচেট এই ফেন্সের নাম কী দিয়েছেন জানো? সারকামফেন্স(circumfence)! আবার এই ডিস্কের রীম বা বেড়ের কাছে একটা রেইনবো বা রংধনু দেখা যায়। এই রংধনুর নাম হচ্ছে রীম-বো!
- বাহ! আসলেই তো জব্বের কাম কর্যাছে গো এই লেখকডা!
- হ্যাঁ মামা। সেই জন্যেই তো ডিস্ক ওঅর্ল্ড আমার খুব পছন্দের একটা সিরিজ। যে কোন ফ্যান্টাসি ভক্তকে আমি এই সিরিজটা রেকমেন্ড করবো। আর আগেই যেটা বললাম, যেহেতু কোন সিরিয়াল নেই তাই যে কোনটা দিয়ে শুরু করা যায়। তারপর পছন্দ হলে যেটা খুশী পড়ে ফেলা যায়।
- হ্যাঁ! এখুন প্যাইচতে প্যারছি। তো মামা যা বুইলল্যা, খুব ভাল্ল্যাইগলো।
- তোমার ভালো লাগলে আমারও ভালো লাগলো। এর পরের দিন দেখা হলে তোমাকে আরেকটা দুর্দান্ত সিরিজের কথা বলবো। হুইল অব টাইম। ঠিক আছে?
- ঠিক আছে মামা। পরে দ্যাখা হবে তাইলে।
- আচ্ছা মামা। বাই। - আর্টিকেলটি লিখেছেন - অয়ন ইসলাম
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....