অঙ্কের বই মানে কেশবচন্দ্র নাগ। আর বাঙালিকে ইংরেজি ব্যাকরণ শিখিয়েছেন পিকে দে সরকার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তাঁর লেখা ‘A textbook of Higher English Grammar, Composition, and Translation’ ঘষটে পেরিয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি।
ওপার বাংলায়, রংপুরে জন্ম। ১৯১১ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ইংরেজিতে এমএ করবেন বলে ভর্তি হলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেকালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরের সুযোগ, হাতের মোয়া মোটেই ছিল না। দস্তুরমত দখল রাখতে হত ভাষাটির উপর। আর কলকাতায় এমএ পড়ার খরচ চালাতে, অনেকেই চাকরি করতেন। প্রফুল্লবাবুও মার্টিন-বার্ন-এ ঢুকেছিলেন। অপমানিত হয়ে বেরিয়ে এলেন, কিন্ত দমে যাননি।
পিকে দে সরকারের গ্রামার বই, গ্রাম-মফস্সল-শহরতলীর ছাত্র-ছাত্রীদের বাইবেল। যারা ইংরেজিটায় একটু কাঁচা, যাদের ভুল হয়ে যায় প্রিপোজিশন-কনজানকশনে, হেডমাস্টারকে ‘ফর্মাল লেটার’ লিখতে গিয়ে হিমশিম খায়, তাদের জন্যই লিখেছেন প্রফুল্ল সরকার। বলা বাহুল্য আজও এই বইয়ের চাহিদা বিপুল। কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের প্রতিটি দোকানে শোভা পায়, ‘...Higher English Grammar, Composition, and Translation.’
শুরু করলেন স্কুলে শিক্ষকতা। রাজশাহীর ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমি স্কুলে ছিলেন প্রধানশিক্ষক। নাম শুনেই বোঝা যায় পূর্ববঙ্গের ৯০% স্কুল কলেজের মত এইটিও স্থাপন করেছিলেন বাঙালী হিন্দুরাই, যার পূর্ণ সুবিধে পেত মুসল_মান বাংলাভাষীরা। ছোট্ট স্কুলটির ছাত্র সংখ্যা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। শিক্ষকমহলে নাম ছড়িয়ে পড়ে সরকার মহাশয়ের।
পড়াতে পড়াতে লক্ষ্য করছিলেন, অধিকাংশ বাঙালি ছাত্ররা দুর্বোধ্য ব্রিটিশ ‘নেসফিল্ড’-এর পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে কাহিল। সমাধান বেরোলো ১৯২৬-এ। পিকে দে সরকারের গ্রামার বই, নেসফিল্ডকে ছাপিয়ে বাজারে হট-কেক। প্রতিবছর পাল্টে যেত সংস্করণ। সময়োপযোগী সংশোধন রাখতেন তিনি।
১৯৪৮-এ দেশভাগের পর মুসল_মানের অত্যাচার বাড়ল। নিজেদের সাত পুরুষের ভিটেবাড়িতে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হল বাঙালী হিন্দুদের পক্ষে। সব ফেলে রেখে ওপার বাংলা ছেড়ে, স্ত্রী-ছেলেমেয়ের হাত ধরে কলোনি সংলগ্ন এলাকায় বাসা বাঁধলেন পিকে দে সরকার। নতুন জীবন শুরু হল। উদ্বাস্তু বাঙালী হিন্দুর জীবন।
যেদিন চলে এসেছিলেন, কেঁদেছিল রাজশাহীর বাসিন্দারা। ধর্ম নির্বিশেষেই। প্রাণের চেয়ে প্রিয় ‘মাস্টারমশাই’কেও হিন্দু হওয়ার অপরাধে দেশ ছাড়তে হল দেখে বাঙালী হিন্দুরা, আর সময় থাকতে পুরো পরিবারকে খতম করে জমিবাড়ির দখল নেওয়া গেল না বলে মুসল_মান বাংলাভাষীরা।
এর ঠিক দুবছর পরে ১৯৫০ সালে নাচোল গণহত্যা। বাংলাভাষী স্থানীয় লোক আর আনসার বাহিনী এবং উর্দুভাষী পাকিস্তানি সৈন্য হাতে হাত মিলিয়ে রাতারাতি পুরো রাজশাহী জেলার আদিবাসী হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্মূল করে দিল। অন্যান্যদেরও ক্ষয়ক্ষতি কিছু কম হল না। বোঝা গেল তীক্ষ্ণধী মাস্টারমশাই কেন সময় থাকতে দেশ ছেড়েছিলেন। মুসল_মানের দেশে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই।
স্থায়ী চাকরি না করে, রয়্যালটির টাকাতে চলেছে অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা। চাহিদা বলতে ছিল না কিছুই। কেবল প্রকাশকদের কাছ থেকে উপহার পেতেন ক্রিকেট ম্যাচের টিকিট। মুসল_মানদের জন্য দেশ হারিয়েও দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে মানুষ করেছিলেন।
তাঁরা কেউ অবিশ্যি ইংরেজি নিয়ে পড়েননি। মেয়েদের বিজ্ঞান পড়তে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারা থাকত বাড়ির বাইরে। হস্টেলে। সত্তর বছর আগের কথা। শুনলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কারণ আজও এই দেশে একটা সম্প্রদায় মেয়েদের বস্তা না পরিয়ে স্কুলেকলেজে পাঠাতে চায় না, সরকার আপত্তি করলে গুণ্ডামি করে।
৮২ বছর বয়স অবধি কাট-ছাট করে গিয়েছেন ব্যাকরণ নিয়ে...
মৃত্যুর ৪৪ বছর পর, আপামর ভারতবাসীকে ইংরেজি শিখিয়ে চলেছেন পিকে দে সরকার। তাঁর ‘বাইবেল’ আসাম-মেঘালয়-মণিপুরেও সমান জনপ্রিয়।
আজও নানা দেশী-বিদেশী কোয়েশ্চন ব্যাংকের তাক হাতড়ে দোকানি ধরিয়ে দিচ্ছেন, প্রায় একশো বছর পুরোনো, লাল মলাটের বইটা। কিছু জিনিস থেকে তো যাবে শিক্ষাব্যবস্থার শেষ দিন অবধি! থাকবেন মাস্টারমশাই, বইয়ের পাতায়।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....