এই আমসত্ত্বরঙা রাত্রিতে - সাবের চৌধুরী

এই আমসত্ত্বরঙা রাত্রিতে


সাত আট হাজার শব্দের মোটামুটি বড়সর একটা গল্প পড়লাম। গল্প ও লেখকের নামটা পরে বলছি। পুরো গল্পটার মধ্যে অপরিণত অপরিণত ভাব আছে। লেখক সম্ভবত গল্প-লেখায় নতুন। ফলে, ভাষাটা কোথাও গাল্পিক, কোথাও প্রাবন্ধিক। প্রচুর অযথা কথাবার্তা আছে। অযথা এই অর্থে—গল্পের যে কাহিনি ও স্বর, সে প্রেক্ষিতে কথাগুলো অনাবশ্যক ও খানিকটা বেঢপ। মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগে, ফলে পড়া থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। একটা গল্প পড়তে গিয়ে যখন টের পাওয়া যায় লেখক ঠিকমতো বলতে পারছেন না, তাড়াহুড়ো করছেন, দৃশ্যগুলো পূর্ব বিবরণ থেকে সৃষ্ট হওয়া পাঠকমনের আকাঙ্ক্ষার সাথে খাপ খাচ্ছে না, কেমন বোকা-বোকা, তখন হতাশাই লাগে। হতাশার আরও একটা কারণ আছে—সেই যে বললাম মাঝে মাঝে প্রবন্ধ-প্রবন্ধ ভাব। এটা সৃষ্টি হয়েছে সম্ভবত এ কারণে—লেখক গল্পের ভিতর দিয়ে বিশেষ কিছু একটা বলে ফেলতে চান, যেটা তার প্রবন্ধের ভিতর দিয়ে বলবার কথা। না, গল্পের ভিতর দিয়ে বিশেষ কোনো ম্যাসেজ দেওয়া যাবে না, তা বলছি না; বলছি গল্পে বিশেষ কিছু বলবার নিজস্ব একটা পদ্ধতি আছে। কবিতার মতোই। কবি আমাদেরকে কিছুই শেখাতে চান না; একটু দূরে দাঁড়িয়ে আপন আনন্দ ও বেদনার কথা স্বগতোক্তির মতো বলে যান শুধু। সেসব শুনে আমাদের হৃদয়গহনে একটা ভাবালুতা ও দ্রবণের সৃষ্টি হয়। তার শব্দ ও বাক্যে উদ্দীপ্ত হয়ে আমরা আক্রান্ত হই ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অনুভবের আবেশে। এরপর সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এর বাণী ও বোধটুকু গ্রহণ করি। জীবনানন্দ যেমনটি বলেছেন—কবিতায় বাণী ও শিক্ষা থাকে, তবে তা সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে রক্ত ও রগরেশার মতো—দৃশ্যমান নয়, নেপথ্যে কাজ করে। গল্প বিষয়টাও তেমনি। গল্প লিখতে গিয়ে বোধ করি লেখক সে জায়গায় খানিকটা ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারপরও পড়া বন্ধ না করে সামনে এগোনোর একটা তাড়া অনুভূত হয় বেশ কিছু কারণে:

গল্পটা মনস্তত্ত্বপ্রধান। একটা দম্পতির প্রেম ও ঘৃণার বিবর্তনটিকে লেখক নানা দৃশ্যের ভিতর দিয়ে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এর কাহিনি বিন্যাসটি জটিল, কিন্তু এই জটিলতা দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি করে না। উপভোগ্য, মনোরম ও কৌতূহলোদ্দীপক। এখানে খুবই মজার ব্যাপার হলো, একই গল্পের ভিতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো কাহিনি, যার চরিত্র, জীবনযাপনের পরিসর, বিষয় ও উপলক্ষ্য কোনো কিছুতেই মিল নেই, এগিয়েছে সমান্তরালে এবং দ্বিতীয় কাহিনিটি প্রথম কাহিনিটিকে দান করেছে পূর্ণতা ও সুন্দর একটা পরিণতি। শেষ দিকে গিয়ে বুঝা যায়, দ্বিতীয় কাহিনিটির জন্মই হয়েছে মূলত প্রথম কাহিনির স্বার্থে এবং ততোধিক বিস্ময়কর হচ্ছে গল্পের সর্বশেষ শব্দটিতে গিয়ে কাহিনি দুটো পরস্পর ভিন্নতাকে অতিক্রম করে এসে মিলিত হয় একই বিন্দুতে। বিবরণ ভঙ্গির কারণে এখানে বারবার সানন্দে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ আছে, দৃশ্যান্তর ও দৃশ্যের আচানক পতনের কারণে চমকে ওঠার আনন্দ আছে এবং কাহিনির যে জটিল ও সহজবোধ্য আনুখা বিন্যাস, এর কারণে পরিণতিটা দেখে-ওঠার জন্য পাঠকও পড়ে যান একটা জেদের ভিতর। সে সাথে প্রচুর পরিমাণে বক্তব্যগত দুর্বলতা, কাঁচা-কাঁচা ভাব থাকলেও লেখক শব্দ ও বাক্য সাজাতে পারেন ভালো। ফলে, দীর্ঘসূত্রিতার ক্লান্তি ও অপরিণতবোধের হতাশা কাটাতে এই ব্যাপারটাও সহযোগিতা করে।  

গল্পটা নিজের ভিতর সমকালীন জীবন ও সমাজকে ধারণ করে বিস্তারিত হয়েছে। এ সমকালীনতা পরিস্ফুট করার জন্য লেখক বেশ কিছু সিম্বল অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন : হোয়াটসঅ্যাপ, নিউজপোর্টাল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি। সেসবের বিবরণে পরে আসছি, তার আগে কাহিনির ব্যাপারে খানিকটা আভাস দিয়ে ফেলা যাক।

গল্পের ভিতর দুটো দম্পতির কথা আছে: গল্পলেখক শওকত হোসেন ও রেবেকা এবং সরকারি চাকুরিজীবী রাজু ও তার স্ত্রী মীরা। শেষ পর্য়ন্ত প্রধান নায়কটা তাহলে কে? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো দৃশ্যটা সামনে রাখলে মূল নায়ক অবশ্যই শওকত। রাজু ও মীরা গল্পের অনেক অংশ দখল করে রাখলেও শওকত চরিত্রটির উপর লেখক অনেক সময় দিয়েছেন। একটা নিউজ পোর্টালের ঈদসংখ্যার জন্য এই গল্পলেখক শওকত একটা গল্প লিখতে বসেছেন। সে গল্পে শুরু হয় রাজু ও মীরার কাহিনিটি। কিন্তু শওকত টের পায় না এই গল্প শওকতের নিজের ভিতরেই একটি আত্মবিবর্তন সৃষ্টি করেছে। এ জন্য দেখা যায় অনেক দূর এগোনোর পর শওকত কাহিনির সমাপ্তিতে আর পৌঁছুতে পারে না। কারণ, এর আগেই সে নিজের কাছে প্রত্যাবর্তিত হয় এবং দীর্ঘ একটা ঘোর কাটিয়ে নিজেকে ফিরে পায় নতুন রূপে। ফলে, দ্বিতীয় গল্পের শেষে যে নিদারুণ একটি পতন ও বিষাদ দেখা দিয়েছে, সেটিই হয়ে উঠেছে প্রথম গল্পে জীবনের জয়গান ও উত্থানের সিঁড়ি। এখানে গল্প ও গল্পলেখক বড় অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

এবার চরিত্রগুলোর উপর একটু নজর দিই এবং খানিকটা ধীরে এগোই—
গল্পের শুরুর লাইনেই আমরা গল্পলেখক শওকতের দেখা পাই। শওকত দোতলায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের রোদ ও প্রকৃতি দেখছে। সময়টা দুপুর। বাইরে মরে আসা দুপুরের রোদ। একটু সময়ের ব্যবধানে রোদ উধাও হয়ে শুরু হয় প্রবল বাতাস। আমরা তখন শওকতের চোখের ভিতর ঢুকে পড়ি এবং তার চোখ দিয়ে প্রকৃতির বিচিত্র চরিত্র অবলোকন করি, সাথে দেখতে থাকি একজন গল্পলেখকের চঞ্চল মনোজগৎটিও।

//শওকত যখন নিজের রুচি আর ‘মচমচে’ শব্দটার উপর বিরক্ত হয়ে রোদের আরেকটু ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল, ঠিক সেই সময় রোদটা গেল চলে। প্রকৃতির মাঝে একটা ম্যাজিক্যাল পরিবর্তন এল। একটু সময়ের ভেতর আকাশ হলো মেঘলা। এর মাঝে শুরু হলো বাতাস। দেখতে দেখতে বাতাসটা বেড়ে গিয়ে গাছপালার ভেতরে গভীর আলোড়ন তুলে ফেলল। বেশ দূরে, বাঁশঝাড়ের মাথাগুলো যেখানে নুয়ে-নুয়ে পড়ছে, সেখানে একটা চিল উড়ছে। প্রবল বাতাসের কারণে চিলের রাজকীয় প্রবাহটা একটা দ্বিধার মধ্যে আটকে গেছে। বেচারা জীবনানন্দ! একটু আগায়, আবার বাতাসের ধাক্কায় তেরসাভাবে পিছিয়ে-পিছিয়ে যায়। কিন্তু এর ভাবসাব দেখে মনে হয় ব্যাপারটা সে উপভোগ করছে খুব। ‘শালার চিলা!’—চিলটাকে অযথাই একটা গালি দিয়ে শওকত দৃশ্যটার ভেতর ডুবে গেল। মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য তাকে বিচিত্র অনুভব দেয়। যেমন এখন, তার মনে হচ্ছে নুয়ে পড়া বাঁশঝাড়, হুহু বাতাস আর পানসে-রঙা আকাশসহ পুরো জিনিসটা তার বুকের ভেতর ঢুকে গেছে। সেখানে একটা চিল এগোতে গিয়ে পিছলে পেছনে সরে যাচ্ছে বারবার। শওকত দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে ঘনীভূত হচ্ছিল, টের পেল একটা ঘোরের মতো কোনো একটি কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, যেখানে নিশ্চয়তা নাই, অনিশ্চয়তাও নাই।//

কবি জীবনানন্দ ও তার জীবনপ্রকৃতিটি যার সামনে আছে, সে এখানের ‘বেচারা জীবনানন্দ’ শব্দ দুটো পড়ার পর চিল ও দ্বিধার আশ্রয়ে একটা বিদ্যুৎবিভা টের পাবে। একই সাথে প্রকৃতির একটা দৃশ্যকে অবলম্বন করে একজন লেখকের মনোজগতে যে বিচিত্র জীবনবোধ জাগ্রত হয়, যেভাবে কেন্দ্র ও নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তা উপভোগ্যই।

এরপরই দেখা যায় শওকতের মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ মারফত একটা ম্যাসেজ আসে—
//এমন সময় টুং করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা শওকতের খুব পছন্দের। প্রথমে জোরালো, এরপর চমৎকার নিয়ন্ত্রিতভাবে ক্রম-লয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। যেন বা শব্দটাকে কেউ পেছন থেকে এসে আলতো টানে নিয়ে গেল স্মৃতির ভিতর। পুরো ঘটনাটা ঘটতে মাত্র দুই সেকেন্ড সময় লাগে। অথচ এই এর মধ্যেই কী অসাধারণ একটা মূর্ছনা তৈরি হয়। শিল্প ব্যাপারটা আসলে এমনই—সামান্যকে অসামান্য করে তোলে। শওকতের মনে হলো, এই শেষ বাক্যটা যদি সে সিঁড়ির আড্ডায় বলে বসত, তাহলে ছেলেরা হই হই করে উঠত।//

ছোট্ট একটা শব্দকে কেন্দ্র করে তার হৃদয় ও চিন্তার মোড় ঘুরে চলে গেছে শিল্পের দিকে। এর একটু পরেই শিল্পকে কেন্দ্র করে আমরা একটা কাল্পনিক বিতর্কও দেখতে পাই। সে সংলাপের একটা জায়াগা খুব ইন্টারেস্টিং—
//ছেলেরা শওকতের কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
-  ‘না, তা করব ক্যান? কিন্তু শিল্পের যে প্রতিষ্ঠিত অর্থ আছে, অর্থাৎ, কোনো কিছুরে সুন্দর কইরা তোলা, এইটা মানতে আপত্তি আছে। সুন্দর না কইরা থাকাও শিল্প হইতে পারে; এবং সুন্দর ও অসুন্দর কোনো কিছু না কইরা থাকাও শিল্প হইতে পারে। দেখার বিষয় হইলো তুমি এরে অবজার্ভ করতেছ কীভাবে। শিল্প বাস্তবে নাই, আছে তোমার মনে।
– ‘তোর মাথা!’
– ‘হা হা হা… এক্সেক্টলি!’
শওকত খেয়াল করল, ওদের উপর ওর মেজাজ খারাপ হয়ে পড়েছে। বিশ্রি একটা গালি দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে রকম কিছু না পেয়ে অস্ফুট স্বরে শুধু বলল—শয়তানগুলা! এই ছেলেগুলো অদ্ভুত কিসিমের। এরা আকৃতিকে অস্বীকার করে এবং সমস্ত কিছুকে করুণা দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে চায়। যেন আনন্দ নাই, বেদনা নাই—অন্তহীন এক ঠাট্টায় বেঁকে আছে সমস্ত মুখ—চরাচর।//

এখানের এই বক্তব্য এবং আরও বিভিন্ন দৃশ্য আমলে নিলে আমরা টের পাই গল্পলেখক শওকত চিন্তায় মূলত ঐতিহ্যপন্থি, আদর্শবাদী এবং একটা স্থির মানদণ্ডে জীবনের পরিশুদ্ধতার পক্ষের লোক। ফলে, শেষের দিকের ‘এরা আকৃতিকে অস্বীকার করে’ বলে ছেলেদের যে নিন্দা করেছে, এর মাধ্যমে সে মূলত সমকালের বিশেষ রকমের আধুনিক মানসকেই অস্বীকার করছে, যারা বলতে চায় সত্য আপেক্ষিক, বস্তুর নিজস্ব আকৃতি ও ব্যক্তিগত ব্যঞ্জনা নাই। ব্যক্তিভেদে তা পরিবর্তিত হয় বরং।

হোয়াটসঅ্যাপের এই ম্যাসেজের মাধ্যমে শওকত একটা গল্প লেখার জন্য অনুরোধপ্রাপ্ত হয় এবং এরপর থেকেই সে লেখা নিয়ে ভাবতে থাকে। এখানে এসে আমরা শওকতের মনোজগতের আরও গভীরে প্রবেশ করি। একটা লেখা হৃদয়ের অন্ধকার থেকে কীভাবে অঙ্কুরিত হয়, সে বিচিত্র দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হই। এখানে তার অতীত স্মৃতি, চলমান জীবন, দাম্পত্য, বহু আগে ভুলে যাওয়া কোনো প্রেম, বস্তু ও অবস্তু সকল কিছু মিলেমিশে একটি মিথস্ক্রিয়ায় সে আপ্লুত হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সময় আমরা শওকতের স্ত্রীকে প্রথমবারের মতো দেখতে পাই। পাকঘর থেকে সে শওকতের কাছে এসে দাঁড়ায় বিরক্তি ও বিস্ময় নিয়ে। এই জায়গাটিতে এসে লেখকের কথাবার্তা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে, সংলাপ কাঁচা, ভাষাও এলিয়ে পড়েছে অনেকটা, কিন্তু এখানে একই সাথে তিনটি ব্যাপার ঘটে: ইতিমধ্যে লেখক চরিত্র হিসেবে শওকত দাঁড়িয়ে গেছে, মূল কাহিনির শুরু এবং শওকত তার গল্পের সূচনাটা পেয়ে গেছে।

শওকতের সে গল্পের শুরুর বিবরণটি পড়া যাক:
//মীরা জানে এখন কী ঘটবে। রাজু একটু আগে দরজায় ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টের কোমর থেকে চামড়ার বেল্টটা নিয়ে আসবে। দরজার কাছে যাওয়া আর আসার ভঙ্গিটা প্রতিবার একই রকম হয়। দৃশ্যটা মুখস্থ হয়ে গেছে মীরার। ঠোঁট দুটো পরস্পর চেপে থাকে। চোয়ালের নড়াচড়া দেখলে বুঝা যায় উপরের পাটির দাঁতগুলো নিচের পাটির উপর শক্তি খাটাচ্ছে খুব। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে এবং চোখের দৃষ্টিটা ঠিক সামনে নয়; তেরসাভাবে কোথায় যেন ফেলে রাখে। চোখের ধারালো দৃষ্টি ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও উত্তেজনার কোনো আলামত নেই। চেহারা দেখলে শুধু এটুকু বুঝা যায়—কারও কথায় তার মেজাজ খারাপ হয়েছে; কিন্তু সে যে মূলত মীরাকে পেটানোর জন্য চামড়ার বেল্টটা হাতে নিতে যাচ্ছে, তা বুঝার কোনো উপায় নাই। রাজু গম্ভীর মুখে মাথাটা একটু বাঁ দিকে হেলিয়ে ধীর পায়ে বেল্টটার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সামান্য এটুকু জায়গা সে সময় নিয়ে পার হয়। ধীরতার এই ব্যাপারটা রাজুর স্বভাবের অসম্ভব সুন্দর একটি দিক। যেন তার কোনো তাড়া নেই।

রাজু সুন্দর, সুপুরুষ। তার চেয়েও বেশি সুন্দর তার সচলতাটি। মীরার মনে আছে, বিয়ের পরপর সে রাজুর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত। যে পরিবেশেই হোক, রাজু খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বসতে পারে। তার বসার স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে পরিবেশটা যেন স্বচ্ছন্দ ও নান্দনিক হয়ে ওঠে। যখন উঠে দাঁড়ায়, স্লো মোশনের মতো, অসম্ভব এক নিরবচ্ছিন্নতার সাথে, চেহারায় সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে। মীরা ওর প্রত্যেকটা তাকানোকে আলাদা করে ধরতে পারে। যেন আকাশের মতো দৃষ্টির রং আর তাকানোর ধরন তার। আর কী সুন্দর করে হাঁটে। অনেকে যেমন পা সোজা রেখেই স্টেপ নেয়, ওর হাঁটাটা এমন নয়। সে পা উঠায়, এরপর হাঁটুর কাছটাতে পরিমাণমতো ভাঙা পড়ে, এরপর মাঝারি দূরত্বে পা ফেলে-ফেলে প্রতিটি পদক্ষেপে সে খুব স্বস্তি ও সুনিশ্চিতভাবে এগিয়ে যায়। এমনকি ও যখন ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে মুখ খুলত, মীরা তাকিয় থাকত। সকল কাজেই একটা ছন্দ, একটা শিল্প ও নান্দনিকতায় ভরপুর হয়ে থাকে, তা যে সামান্য কাজই হোক। রাজুর কথা বলাও সুন্দর। দৃষ্টির বার্তা, শরীরের ভাষা আর উচ্চারিত শব্দ—এ তিনের মাঝে খুব সুন্দর সংযোগ ঘটাতে পারে সে। মীরার কেমন পাগল-পাগল লাগত রাজুর এই ব্যাপারগুলো। রাজু তার সেই সমস্ত সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা নিয়ে চামড়ার বেল্টটা হাতে করে ফিরে আসছে মীরার দিকে।//

কোমল স্মৃতি ও কর্কশ বাস্তবতা—এ দুই হাত ধরাধরি করে চলেছে রাজু-মীরার পুরো গল্পজুড়েই। মীরা খুবই নির্মমতায় আটকা পড়ে বারবার স্মৃতির কাছে হাত পাতে। এভাবে সে যেন বাস্তবতাকে প্রতিহত করতে চায়। সে ধারাবাহিকতায় আরও সামনে গিয়ে দেখি মীরাকে প্রহার করার জন্য বেল্ট প্যাঁচানো হাতটা যখন মীরার দিকে নেমে আসছে, সে তখনো স্মৃতির ভিতর আশ্রয় নিচ্ছে মরিয়া হয়ে। ফলে, সে হাত পাল্টে যাচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোনো দৃশ্যের ভিতর। সে দৃশ্যান্তরটা এবং দৃশ্য থেকে বের হয়ে আসা: দুটো বিষয়ই দেখা যাক—
 
//রাজু বেল্ট-প্যাঁচানো হাতটা উপরে উঠাচ্ছে।
— হেঁ, হাতটা আরেকটু উঠাও। দ্রুত করো। আচ্ছা, দাঁড়াও, আগে ব্যাগটা দাও আমার হাতে। মীরা ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেয়ালের ওপারে ছেড়ে দিলো, ঘাসের উপর। বেশ উপর থেকে পড়েছে ব্যাগটা। ভেতরে পাথরের কিছু জিনিসপত্র আছে, কী অবস্থা হলো কে জানে। চকলেটগুলো মনে হয় গুড়ো হয়ে গেছে। অবশ্য ঘাসগুলো পুরো হওয়াতে কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে হয়তো।//

বিয়ের পরপর মীরা আর রাজু ঘুরতে বেরিয়েছিল, সেখানে একটা দেয়াল টপকাতে গিয়ে এমন করে হাত উঠানো ও নামানোর ব্যাপার ঘটেছিল, সে দেয়ালের কাছটিতে দাঁড়িয়ে মীরা রাজুকে নামতে সাহায্য করছে এবং দিকনির্দেশনা দিচ্ছে:
//এবার হাত নামাও। রাজুর হাতটা নেমে আসছে নিচের দিকে। মীরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ। দুই হাত উপরে তুলে মাথা নুইয়ে ফেলেছে। দিশেহারা লাগছে খুব। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। কিন্তু এই বেল্টের বাড়ি কোনোভাবেই সহ্য করার মতো নয় মীরার পক্ষে। মীরার মনে পড়ে ছোটবেলার মক্তবের কথা।//

এভাবে মীরা ও রাজুর কাহিনি এগিয়েছে প্রেম ও ঘৃণার ভিতর দিয়ে, স্মৃতি ও বাস্তবতার আশ্রয়ে, একই সাথে এগিয়েছে গল্পলেখক শওকতের সাথে তার স্ত্রী রেবেকার গল্পও। উভয় দম্পতির জীবনেই প্রেম ছিল, কিন্তু ধীরে তা বিবর্তিত হয়ে ঘৃণা ও বিরক্তিতে রূপ নিয়েছে। এই বিবর্তনটা কেন হলো এ নিয়ে গল্পলেখক শওকত এবং তার গল্পের নায়িকা মীরা দুজনই বিস্মিত।

মীরা-রাজুর গল্পের শেষ দিকে গিয়ে বিশেষ একটি ঘটনা ঘটে। দাম্পত্য জীবনে অসুখী হয়ে তারা দুজনেই মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে গোপন প্রেমে জড়িত হয় পরস্পরের সাথে। মীরা টের পায় না সে মূলত নিজের স্বামী রাজুর সাথেই সম্পর্কে জড়িয়েছে, রাজুও টের পায় না নীলিমা নামে যে নারীটির সাথে সে যোগাযোগ করছে, সে মূলত নিজের স্ত্রী মীরাই। দেখা যায় মাত্রই মীরা আর রাজু স্বামী-স্ত্রী হিসেবে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় করে যার যার রুমে চলে যাচ্ছে এবং মুহূর্তকাল পর গোপন পরিচয়ের আড়ালে পরস্পর আবার নিমজ্জিত হচ্ছে গভীর অনুরাগ ও প্রীতির সমুদ্রে।

গল্পলেখক শওকত এ জায়গাটিতে এসে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যায়। ভেবে পায় না এটা কীভাবে সম্ভব? সে আর সামনে এগোতে পারে না। শওকতের ইচ্ছে ছিল গল্পের শেষে গিয়ে দুজনের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেবে। এই নাটকীয় মুহূর্তটি কীভাবে ঘটাবে, দুজন কীভাবে বিস্মিত হবে, ধাক্কা খাবে, তারপর কী হবে, সব কিছু ভেবে গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা করতে তার ভালো লাগেনি। কেন? হেপি এন্ডিং দিলে গল্প ভালো হয় না এই জন্য? একটা বিচ্ছেদ রেখে দিতে হবে, একটা নিষ্ঠুর অপ্রাপ্তির বেদনা, হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলা—এই রকমের তীক্ষ্ম বেদনাগুলো থাকলে গল্পটা হয়তো হিট করবে; কিন্তু দুটো মানুষ, যারা ছয় বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে নিজেদেরকে খুঁজে পায়নি, মাত্র তিন মাসের সামান্য অ-পরিচয়ের ভিতর দিয়ে কী তুমুলভাবে আবিষ্কার করেছে পরস্পরকে; এ কি জীবন নয়? এই গল্প সে লিখবে না কেন? কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না মূলত অন্য একটি কারণে। কেন? পড়ুন:

//রাজুর মানসিক অবস্থানটি তার কাছে অত্যধিক জটিল মনে হয়েছে। এই যে স্ত্রীকে ঘৃণা ও প্রহার করা, আবার ক্ষণকাল পরে সেই একই ব্যক্তি, যার চিন্তা ও অনুভব, রুচি ও অভিজ্ঞতা, মনন ও কথার সুর এক ও অভিন্ন, তার সাথেই অন্য নামের আড়ালে থেকে গভীর প্রেমে লিপ্ত হতে পারা—শওকত এই জায়গাটির কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না। নারী যদি ভিন্ন কেউ  হতো কিংবা ভিন্ন চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের,  হিসেবটা তবে সহজ ছিল; কিন্তু এখানে তো মূলত সে নিজের স্ত্রীকেই উন্মোচিত করেছে, নতুন এক রূপে। ফুল বিছানো পথে হেঁটে গিয়ে সে মূলত মীরার হৃদয়টিতেই প্রবেশ করেছে, যে হৃদয়টিকে এই সে-ই বিষে-বিষে নীল করে এসেছে মুহূর্তকাল আগে। এটা কেন সম্ভব?  শওকতের কেন যেন মনে হচ্ছে, নীলিমার পরিচয় পাওয়ার পর রাজুর মধ্যে একটা পতনের সৃষ্টি হবে, এবং সে কিছুটা হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে। সে ভেবে পাচ্ছে না এখন কী করবে।

শওকত ধীরে ধীরে একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কপাল ঘামছে এবং একটা জিজ্ঞাসার আবর্তে ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছে। মীরা, রেবেকা, নীলিমা—তিন জন নারী, তার থেকে একটু দূরে, তাকে মাঝে রেখে, তার দিকে মুখ করে তেরসাভাবে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নাই। কোনো চাওয়া ও জিজ্ঞাসা নাই। শুধু স্মিত একটু হাসিতে খোদাই হয়ে আছে সুন্দর ও অসুন্দরের ঊর্ধ্বে ওঠা আবহমান এই তিন নারীমূর্তির মুখচ্ছবি। শওকতের পায়ে দ্বিধা, হাত নিশ্চল; কিন্তু অনুভূতি? তীক্ষ্ম ফলার মতো হয়ে আছে। ধনুকের ছিলার মতো টানটান। ‘আমাকে ভুলে যেয়ো’ বলা তরুণীর অভিমানের মতো প্রখর যেন। টের পায়, হৃদয়ের গহিন অন্ধকারে কোথাও এক ফোঁটা রোদ ঢুকেছে। এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।//

কে আসছে? শওকতের স্ত্রী রেবেকা। শওকতের সাথে মানসিক এই দূরত্বে দিন-দিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লোকটাকে নিয়ে যেতে হবে। শওকত শুনছে:
//ক্লান্ত পায়ে উঠে আসছে কেউ, ধীর গতিতে। পদশব্দের মাঝে ঘুমের আবেশ ও ঘুমুতে না পারার আক্ষেপ বেজে-বেজে উঠছে। শওকত ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দেড়টা। রেবেকা আসছে। যখন প্রবল বাতাস উঠেছে, এই আমসত্ত্বরঙা রাত্রিতে; যখন নৈঃশব্দের ভেতর ছোট্ট একটি শব্দ আড়মোড়া ভাঙছে, তখন রেবেকা উঠে আসছে, ধীর পায়ে, যেন গতকাল আসেনি, এবং কোনো দিন আসেনি। শওকত চোখ বন্ধ করে রেখেছে। পেছনে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। রুমের ভিতর প্রবেশ করেছে, তার স্ত্রী, রেবেকা। এবং শওকত যখন চোখ খুলে আলস্যে ঘুরে তাকাল, দেখল সেখানে রেবেকা নাই; দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক নারীমূর্তি—নিলীমা।//

এই যে তিনটি গল্পের ভিতর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের তিনটি নারীমূর্তি উঠে এসে গল্পলেখক শওকতকে একটা গোলক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল, শওকত সে ধাঁধাটি শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এবং এ কারণেই আমরা দেখি, সর্বশেষ রেবেকার সাথে তার সাক্ষাৎ যখন হচ্ছে, তখন রেবেকার জায়গায় প্রতিস্থাপিত হচ্ছে গল্পের নীলিমা চরিত্রটি। পুরো গল্পের উপার্জন এটিই—এই শেষ শব্দটি। এখানে এসে তিনো গল্পের গতিপ্রবাহ একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়ে গল্পটিকে দারুণ এক পূর্ণতা দান করেছে। যে অভ্যস্থতা, প্রাত্যহকিতা উপর্যুপরি সঙ্গ ও সঙ্গমে নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছিল অলক্ষ্যে ও অবহেলায়, নীলিমা চরিত্রটির ভিতর দিয়ে সে যেন ফিরে পেয়েছে সেই পুরনো প্রেমময় স্ত্রীকে। গল্পের প্লটটি দারুণ, ম্যাসেজটাও গভীর, চমকগুলোও উপভোগ্য; কিন্তু গল্পের অনভ্যস্থ ভাষা ও প্রাবন্ধিক প্রবণতা গল্পটিকে ফুটতে দেয়নি ভালোভাবে।

এবার বলি গল্পের লেখক কে? দন্তস্য চোধুরী। হ্যাঁ, অধম নিজেই লিখেছিলাম গল্পটি, ফাতেহের ঈদসংখ্যায়। জীবনে এই একটা গল্পই লিখেছিলাম এবং তা ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ একটি প্রজেক্ট। যখন দেখলাম আমরা গল্প হয় না, তখন কবিতার মতোই সে চেষ্টাও বাদ দিয়েছি। সামনে কখনো চেষ্টা করব এমন দুরাশাও পোষণ করি না। বোকার মতো যে একটি লিখে ফেলেছিলাম, ভাবলাম খানিকটা স্মৃতিচারণ করা যাক। গল্পের নাম? বলতে লজ্জা লাগছে। কিছুটা বিদঘুটে টাইপ। হা হা …

   • 
সাবের চৌধুরী 
কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ