জীবন থেকে নেয়া
মায়ের খোঁজে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিষিদ্ধ পল্লিতে!
কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় একবার নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়েছিলেন। তা–ও গিয়েছিলেন তাঁর মায়ের খোঁজে।
শুনে খুব অবাক হচ্ছেন, তা–ই না? কারণ, বিভূতিভূষণের মা তো তাঁর শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন। তাহলে কোন মায়ের খোঁজ করতে গণিকালয়ে গেলেন পথের পাঁচালীর এই লেখক? সেই কাহিনির সূত্র পেতে হলে তাকাতে হবে বিভূতিভূষণের জীবনে।
বিভূতি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন কিছুটা লাজুক আর ভীতু প্রকৃতির। অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বরাবরই ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। পাঁচ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে কলকাতায় আসেন তিনি। পারিবারিকভাবে তাঁরা ব্রাহ্মণ হলেও পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। টাকার অভাবে তাঁর দরিদ্র বাবা কিছুতেই ভালো কোনো বাড়ি ভাড়া পাচ্ছিলেন না। ফলে শহরের একপাশে কিছুটা অনুন্নত জায়গায় ঘর ভাড়া নিলেন তাঁর পিতা। তাঁদের ঘর থেকে নিকট দূরত্বে ছিল নিষিদ্ধ এক পল্লি। তো এই পল্লির এক নারী একদিন চলতি পথে দেখলেন ছোট্ট বিভূতিভূষণকে। মা–হারা বিভূতির মায়াবী চেহারা ওই নারীর মন গলিয়ে দিল, শিশুটির জন্য খুব দরদ হলো তাঁর। প্রায়ই এসে তিনি বিভূতির সঙ্গে খেলতেন, মাঝেমধ্যে খাইয়ে-নাইয়েও দিতেন।
ছোট্ট বিভূতি এই নারীর ভেতর তার কাঙ্ক্ষিত আদর-স্নেহ খুঁজে পেয়েছিল। ওই নারীও নিজের আয়–রোজগার থেকে নানা সময় খেলনা ও মজাদার খাবার নিয়ে আসতেন বিভূতির জন্য।
মাঝেমধ্যেই জেদ ধরতেন বিভূতি, বাবার সঙ্গে ঘরে থাকবেন না, ওই নারীর সঙ্গে ঘুমাবেন। এভাবে একপর্যায়ে নিষিদ্ধ পল্লির সেই নারীকে মা জ্ঞান করতে শুরু করেন তিনি। পরে তাঁর বাবা বাড়ি বদলালে ওই নারীকে তিনি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় তিনি তাঁকে খুঁজে বেড়াতেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন প্রতিষ্ঠিত লেখক। আরেক লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে একই মেসে থাকেন। একদিন নিষিদ্ধ পল্লির সেই নারীর কথা তাঁর খুব মনে পড়ল। তিনি ঠিক করলেন, এবার নিষিদ্ধ পল্লিতেই তাঁকে খুঁজতে যাবেন। যে করেই হোক, তাঁকে দু-নয়ন দেখতেই হবে ছোটবেলার সেই মাকে।
তবে পুরোনো সেই নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়ে তিনি যতই বলেন, তাঁর স্বজন এক নারীকে খুঁজতে এসেছেন; কেউ তাঁর কথায় আমল দেয় না, বিশ্বাসও করে না। সবার এক কথা, তাঁর মতো সাহেব-বাবুদের আত্মীয় এখানে থাকে কী করে! অল্পবয়সী যুবতীরা বিভূতির এসব আবেগপ্রবণ কথা শুনতে নারাজ। তাঁরা তাঁকে খদ্দের ভেবে টানাটানি শুরু করলেন। শেষে তাঁকে নিয়ে এমন টানাহেঁচড়া শুরু হলো যে কাপড় নিয়ে পালানোই দায় হয়ে পড়ল। অতঃপর দৌড়ে, পালিয়ে কোনোক্রমে রক্ষা পেলেন বিভূতিভূষণ।
মেসে এসে এ কাহিনি একান্ত বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে বললে তিনি প্রথমে একচোট হেসে নেন। পরে বিভূতিভূষণের কোনো আক্কেল নেই বলে তাঁকে খুব ভর্ৎসনা করেন।
এরপরও দুই বন্ধু মিলে আরও অনেক নিষিদ্ধ পল্লিতে সেই নারীকে খুঁজেছেন। শেষ বয়সে পৌঁছেও ছোটবেলায় দেখা সেই নারীর কথা খুব বলতেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু আফসোস, তিনি আর তাঁকে কখনো খুঁজে পাননি।
সূত্র: ‘অচেনা বিভূতি’, আনন্দবাজার পত্রিকা
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....