- বই : দুইশো তেরোর গল্প
- লেখক : তাসনিয়া আহমেদ
- প্রচ্ছদ : সানজিদা স্বর্ণা ও তাহমিদ রহমান
- জনরা : সমকালীন উপন্যাস
- ধরণ: স্ট্যান্ডার্ড সাইজ-হার্ডকাভার
- মলাট মূল্য : ৩৫০ টাকা
- পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২২৪
"বাটালি আর হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে মেয়েটার মাথার শক্ত খুলি সরানোর পর লালচে রঙের মেনিনজেসের আবরণ দেখা গেল। পাতলা পর্দাটা সরিয়ে দিতেই বের হয়ে এল ধূসর রঙের ব্রেইন। একটু আগে যে কামিজটা মেয়েটার আব্রু রক্ষা করছিল,সেই কামিজেরই ছেঁড়া অংশ দিয়ে একটু মুছে নেয়া হলো ব্রেইনটাকে। বিষের বোতল হাতে নেয়ার সময়ও মেয়েটা বোধহয় ভাবতে পারেনি, যে মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছে, সেই মস্তিষ্ক মুছে নেয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে সেই কাপড়টাই, যেটা সে মৃত্যুর সময় পরে ছিলো।
এটা আমাদের দেখা প্রথম পোস্টমর্টেম। এই মেয়েটার সারা শরীর কেটেকুটে, পরীক্ষা করে খুঁজে বের করা হবে তার মৃত্যুর কারণ। আমরা গ্যালারিতে বসে আছি। আমাদের সামনে একটু দূরেই শক্ত সিমেন্টের টেবিলের ওপর মেয়েটার মৃতদেহ রাখা। হারান ডোম আর তার সহকারী আরেকজন ডোম মিলে তার রূপবতী দেহ ব্যবচ্ছেদ করে যাচ্ছে। বুকের ঠিক মাঝখান থেকে পেট পর্যন্ত দক্ষ হাতে ছুরিটা চালিয়ে দিলো হারান।
দুপুর আড়াইটার পশ্চিমে হেলে পড়া রোদ জানালা গলে এসে পড়েছে পোস্টমর্টেম রুমের মেঝের ওপর। গাছের পাতার ছায়া রোদের ওপর এসে অদ্ভূত সুন্দর নকশা তৈরী করেছে। আমার মনে হলো, স্রষ্টা আগে থেকে এই বিষয়টা ভেবে এই ডিজাইনটা তৈরী করেছেন। লাশ কাটাকাটি করা বা দেখার মানসিক চাপ যখন অসহ্য হয়ে যাবে, হুট করে চোখ ফিরিয়ে নিলেই রোদের মধ্যে পাতার নকশা দেখা যাবে। কী সুন্দর মনভোলানো ব্যাপার!
তরু ফিসফিসিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "তোমার কি মন খারাপ? শরীর খারাপ লাগছে? বের হয়ে যাবে?"
আমি কি অনেকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে আছি? ও টের পেলো কীভাবে? মাথা নেড়ে না করে আবার পোস্টমর্টেম টেবিলে ফিরলাম।
কতো বয়স হবে মেয়েটার? ম্যাডাম বললেন চৌদ্দ। কৈশোরের সমস্ত লাবণ্য তার শরীরে এসে ভর করেছে। বেঁচে থাকতে মেয়েটা কেমন ছিলো, জানতে খুব ইচ্ছা করছে। এই বয়সের মেয়েরা সাধারণত লাজুক ধরণের হয়। এই মেয়েটা হয়তো তাইই ছিলো; অপরিচিত মানুষের সামনে হয়তো আসতেই চাইতো না সে। অথচ মৃত্যুর পর আর কোন আগল রইলো না। এক ঘর অপরিচিত মানুষের সামনে তার উন্মুক্ত দেহের ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে।
সম্ভবত বাকিরাও আমার মতো স্তম্ভিত হয়ে আছে। এই মেয়েটা, তার মৃত্যু, আর তার এই পোস্টমর্টেম সবাইকে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। আসিফ নামের একটা ছেলে জিজ্ঞেস করলো, "ম্যাম, মৃত্যুর কারণ কী মনে হচ্ছে?"
ম্যাম ব্যাখ্যা করলেন, "মুখ থেকে গড়িয়ে আসা ফেনার দাগ দেখিয়েছি তোমাদের। বিষের তীব্র গন্ধ ছিলো মুখের কাছে। পাশেই পড়ে ছিলো সেই বিষের বোতল। পাকস্থলীতেও একই গন্ধ পাওয়া গেছে। তার মানে বিষ তার পেটে গেছে। সেই বিষ সে নিজেই খেয়েছিলো, নাকি তাকে সেই বিষ খাওয়ানো হয়েছিলো সেটা বের করা পুলিশের কাজ। আমরা শুধু কারণ বলবো। চলো তোমাদের আরেকটা জিনিস দেখাই।"
আরেকটা জিনিস দেখার জন্য উৎসাহী অনেকেই একটু এগিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। আমার ইচ্ছা করলো না। সবসময় সবকিছু শিখতে ইচ্ছা করে না আমার।
মেয়েটার তলপেট কাটা হয়েছে। ম্যাডাম দেখিয়ে দিচ্ছেন, নারীদেহে জরায়ুর অবস্থান। ফার্স্ট ইয়ারে যে কয়টা ক্যাডাভার দেখেছি, সবই পুরুষ মানুষের। নারীদেহের অভ্যন্তরীন এনাটমি আমাদের তাই এই প্রথম দেখা। ম্যাডাম হারানকে নির্দেশ দিলেন, সাবধানে জরায়ুটা কাটতে।
জরায়ু কাটার পরে সেখানে আরেকটা জিনিস পাওয়া গেলো।
একটা গর্ভফুল, আর তার সাথে লেগে থাকা ছোট্ট একটা শিশু!
হারান ডোমের হাত গর্ভফুল থেকে বের হয়ে আসা রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেছে। রক্তমাখা হাতে সে ছোট বাচ্চাটাকে তুলে ধরে ম্যাডামকে দেখালো।
আমরা কেউ কখনো আর আগে এই সাইজের ছোট শিশু দেখিনি। হাতের তালুর চেয়েও ছোট একটা শিশু; তার ছোট একটা মাথা, ছোট ছোট হাত-পা, বন্ধ হয়ে থাকা ছোট ছোট দুইটা চোখ। দেখে মনে হচ্ছে, এই যে ঘুমিয়ে আছে, জাগলেই পুরো ঘর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠবে সে!
কিন্তু শিশুটা কাঁদলো না। তার মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তাকে এই পৃথিবীর আলো দেখাবে না। একসাথে দুজনের নিয়তি নির্ধারণ করতে তার মা বেছে নিয়েছে একটা বিষের বোতলকে। এই পৃথিবীতে তারা কেউই আর ফিরবে না।
পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। মেয়েটার পাকস্থলিতে থাকা বিষের গন্ধ আর রক্ত-মাংসের গন্ধের সাথে অদ্ভূত এক বিষাদ মিশে ক্লাসের বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। সব জানালা খুলে দিলেও এই গুমোটভাব কাটবে না।
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট করার মতো সব তথ্যই বের হয়ে এসেছে। প্রয়োজনীয় প্রমাণ রেখে মেয়েটার শরীর এখন সেলাই করে দেবে ডোমেরা। ম্যাডাম বললেন, "প্রায় বিকাল হয়ে এলো। তোমরা আজকে চলে যাও।"
আসিফ ছেলেটা আবার প্রশ্ন করলো, "ম্যাম, এটা তাহলে আত্মহত্যাই?"
"আত্মহত্যা তুমি নিশ্চিত করে বলতে পারো না। হত্যাও হতে পারে।"
"আমরা এটা জানবো না?"
"পুলিশি তদন্তে বের হলে জানবে। আমরা আপাতত মৃত্যুর কারণ এবং প্রমাণসহ রিপোর্ট করবো। সেই অনুযায়ী পুলিশ তাদের তদন্ত করবে।"
"কিন্তু…" সেই কিন্তু বলে আসিফ আর কথাটা শেষ করতে পারলো না।
এই কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের মনেই বোধহয় জেগে ছিলো। একটা চৌদ্দ বছর বয়স্ক অবিবাহিত কিশোরী, তার গর্ভের অনাগত সন্তান, একটা বিষের বোতল। আমরা সবাই এই সমীকরণের সর্বশেষ ফল জানি। তবু এই কিন্তুটা সবার মনে জেগে থাকে। এর উত্তর আমাদের কারো কাছে নেই। মেয়েটার কাছেও বোধহয় ছিলো না। তাই সে শুয়ে আছে মর্গের ঠান্ডা, শক্ত টেবিলে। আমাদের মন সেই পাথুরে টেবিলের চেয়েও শক্ত। তাই সমস্ত কিন্তুকে আমরা একপাশে সরিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসি।
দরজা দিয়ে বের হয়ে আসার ঠিক আগমুহূর্তে একবার পেছন ফিরে তাকালাম আমি। পশ্চিমের রোদ হেলতে হেলতে এবার মেয়েটার গায়ে এসে পড়েছে। পাশে শুয়ে থাকা শিশুটাও পৃথিবীর রোদের ভাগ পেয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।
বাইরে পুলিশ অপেক্ষা করছে লাশ নিয়ে যাবে বলে। পরিবারের লোকেরাও আছে, লাশ বুঝে নেবে বলে। ছোট বাচ্চাটাকে বোধহয় মায়ের সাথে এক কবরেই শুইয়ে দেবে আবার। মায়ের পেটের ভেতর অন্ধকারে ছিলো শিশু, আবার অন্ধকারেই ফিরে যাবে।
তার আগ পর্যন্ত ওরা দু'জন না হয় আরো কিছুক্ষণ রোদ পোহাক!"
উপন্যাস দুইশো তেরোর গল্প থেকে। বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণের প্রি-অর্ডার চলছে। অটোগ্রাফসহ প্রি-অর্ডারের শেষ সময় আজকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। চারটা থেকে থাকছি Satirtho Prokashona এর অফিসে, চাইলে অটোগ্রাফসহ অর্ডার করতে পারেন বয়স যখন ষোলোই সঠিক কিংবা নিছক গল্প নয়ও।
©তাসনিয়া আহমেদ
লেখক ও চিকিৎসক
সতীর্থ প্রকাশনার এই বছরের সবচেয়ে প্রিশিয়াস প্রজেক্ট দুইশো তেরোর গল্প।
মৌলিক এই উপন্যাসটি পড়ার পরে প্রকাশনার সকলেই, এমনকি লেখক বেশ দ্বিধান্বিত ছিলেন যে কেমন প্রচ্ছদ এই বইয়ের জন্য সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে পুরো উপন্যাস পড়ে একটা বিষয়ই মাথাতে এসেছিল যে এইটা উপন্যাস হলেও জীবনের একটা সুমধুর স্মৃতি। বইয়ের এক একটা অংশ যেন ডায়েরীর পাতা।
এরপরে প্রচ্ছদকারকে প্রচ্ছদ করতে বলার পরে তার সাথে কী ঘটেছিল তা নিচের অংশ থেকেই জানতে পারবেন।
"বেশ কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে 'দুইশো তেরোর গল্প' উপন্যাসটি নিয়ে পোস্ট দেখছিলাম। কখনো সতীর্থর পেইজ থেকে কখনো তাহমিদ ভাই কখনো তাসনিয়া আপুর ছোট ছোট লেখাগুলো থেকে বেশ ভালোভাবে একটা ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম যে একটা উপন্যাস আসছে আর সেটা নিয়ে ওনারা সবাই খুব এক্সাইটেড!
তো হঠাৎ একদিন তাহমিদ ভাই ম্যাসেজ দিয়ে বললো আপা দুইশো তেরোর গল্প উপন্যাসের প্রচ্ছদ করতে হবে। যে বই নিয়ে উনারা এত আশা ভরশা করে আছে সেই বই আমাকে করতে দিচ্ছে। তাও শহরের উষ্ণতম দিনের প্রচ্ছদের মতো কিছু একটা চমক চাইছে। আমি তো অবাক! বই পড়ে কনফিউজড হয়ে গেলাম বেশ! কারণ পুরো বইটাই একটা আস্ত থিম! আলাদাভাবে কোনো থিম পাচ্ছিলাম না। পুরো বইটাই আবেগ মিশ্রিত। তাসনিয়া আপুর দেয়া কিছু ধারণা আর পিডিএফ (চোখের সমস্যার কারণে খুব কষ্টে পড়েছি 😑) পড়ে এলিমেন্ট নিয়ে কিছু একটা দাঁড় করালাম। সেটা ডেমোতে ইউজ হয়েছে। তারপর তাহমিদ ভাই ডায়েরি টাইপ কিছু একটা আইডিয়া দিলেন। সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি আর এলিমেন্ট নাড়াচাড়া করে তাহমিদ ভাইকে পাঠালাম ভাই তো প্রচ্ছদ দেখেই বলে এটাই লাগবে আমার যাই হোক তারপরে ব্যাক কাভার ও ফ্ল্যাপ এসবের কাজ তাহমিদ ভাই খুব যত্ন সহকারে করেছেন। সতীর্থের সাথে এইটা আমার দ্বিতীয় কাজ হলেও প্রকাশকের কাছ থেকে যে হেল্প টা পাই তা আসলেই অতুলনীয়।
দুইশো তেরোর গল্প নিয়ে সবাই খুবই আশাবাদী। আমিও আশা করছি বইয়ের প্রচ্ছদ আর বইয়ের লেখা সকলের নজর কাড়বে।
সত্যি বলতে প্রচ্ছদের পুরো কাজেই আমাদের চেষ্টা ছিল যেন পুরো বইয়ের সবকিছু এবং দুইশো তেরো নম্বর রূমের স্মৃতিগুলো এক জায়গাতে করতে পারি।
আমরা আসলেই পেরেছি কিনা তার উত্তর দুইশো তেরোর বাসিন্দারাই বলতে পারবেন।
তো এই হলো আমাদের "দুইশো তেরোর গল্প" উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গ প্রচ্ছদ।
বইটি মাত্র ২৩৫ টাকায় প্রি অর্ডার করতে নক করুন সতীর্থ প্রকাশনার পেজে; কুরিয়ার কিংবা ডেলিভারি চার্জ ফ্রী।
"দুইশো তেরোর দরজা খুলে দিলাম। পাঠককে সাদর আমন্ত্রণ।" -তাসনিয়া আহমেদ
ফ্লাপের কথা:
কৈশোর পেরিয়ে তরুণ হয়ে ওঠার টলমলে সময়টায় পড়ার জন্য ঘর ছাড়তে হয় যাদের; তাদের শুরুটা কেমন হয়? এক ঝাঁক অপরিচিত মুখের মধ্যে তারা কি নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে, নাকি সেই অপরিচিত মুখগুলিকেই সবচেয়ে আপন করে নিয়ে জীবনের নতুন ধাপটায় পা রাখে দৃপ্তভাবে? জীবনের তিক্ত সত্যগুলিকে আবিষ্কার করার ফাঁকে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি বয়ে আনা মানুষগুলির সাথে জীবনকে চিনতে পারার গল্পের নাম ‘দুইশো তেরোর গল্প’। শুধুই হোস্টেলের রুম নাম্বার নয়, বরং চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী রঙিন সময়ের নাম ‘দুইশো তেরোর গল্প’। পড়তে পড়তে পাঠক হারিয়ে যাবেন ফেলে আসা সেই সময়টায়, যখন বন্ধুর সাথে চায়ের আড্ডায় বসে জীবনের সব জটিলতাকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দেয়া যেতো।
দুইশো তেরোর দরজা খুলে দেয়া হলো। পাঠককে সাদর আমন্ত্রণ!
কাহিনী সংক্ষেপ:
ইফাকে হোস্টেলে রাখতে এসে ইফার মা হুহু করে কেঁদে উঠলেন। ইফার বাবা চোখ মুছলেন রুমালে। তারা চলে যেতেই দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ইফা। পরদিন কমনরুমে কেউ ইফাকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। ইফা বিরক্ত হয়ে উঠলো। অপরিচিত কেউ কেন তাকে তুই-তোকারি করবে। পাশেই একজন হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাদের কমনরুমে প্রায় চৌত্রিশ টা চৌকি। সবাই যে যার মত কথা বলছে, কেউ গল্প করছে, কেউ জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। এত শব্দের মধ্যে এখানে কেউ কিভাবে থাকবে তাই ভাবছে ইফা।
পরদিন সকাল আটটায় ক্লাস। সকাল ছয়টায় এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে ইফা দেখতে পেল কালকের হইহুল্লোড় করা রুমে এখন দুই একটা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই নেই। একটু পরেই সবাই উঠে তৈরি হয়ে গেল ক্লাসে।
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অনেকগুলো নতুন মুখ আজ প্রথম ক্লাসে। ক্লাস শেষে আবার সবাই তাদের কমনরুমে ফিরে এসেছে। প্রতিদিন ক্লাস এবং ক্লাস শেষে ফিরে আসা কমনরুমে। এর মাঝে প্রতিদিন ঘটে নানা রকম ঘটনা। মশারি খাটানো, সকালের এলার্ম, ব্রাশ টুথপেস্ট ফেসওয়াশ তোয়ালে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, একে অপরকে ডেকে তোলা, জন্মদিনের কেক কাটা, চাঁদা জড়ো করা, একে অপরের হাসি-কান্নায় অংশ নেয়া এসবের মধ্যে সবাই পরিচিত হয়ে গেল একে অপরের সাথে। তরু,রিচা, বিভা, আদ্রিজা, মায়া, রুপা আরো অনেকের সাথে। আরো অনেকের গল্প গেঁথে যেতে থাকলো একটি অধ্যায়ে। সকলে মিলে যেতে লাগলো সকলের জীবনের জানা-না জানা নানা গল্পে।
দীর্ঘ সময় তাদের কমনরুম জীবনের পর তারা পেয়ে গেল নিজেদের জন্যে রুম। ইফা, রিচি, তরু আর বিভার রুম নাম্বার ২১৩। এখান থেকে শুরু হলো নতুন এক গল্প। দুইশো তেরোর গল্প.....
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
দুইশো তেরোর গল্প উপন্যাসটি মূলত বন্ধুত্বের। এই গল্পটা রুপা, রিচি, তরু, আদ্রিজা, রাত্রি, মায়া, ইফা, অভি, আহনাফের। গল্প বলার সাধারণ ও সাবলীল ভঙ্গিতে পাঠক কে কখনো হাসাবে কখনো কাঁদাবে। এখানে কোন মুখ্য চরিত্র নেই। গল্পটা সবার ছোট ছোট গল্পের বুনোটে তৈরি। জড়িয়ে আছে সকলের আবেগ, ভালোবাসা,বাস্তবতা,কান্না, হাসি আর খুনসুটি। তাদের শিক্ষার্থী থেকে পেশাদার হওয়ার গল্প; তাদের ডাক্তার হয়ে ওঠার গল্প।
খুবই সাধারণ প্লট। টুকরো টুকরো গল্পের বুনন। সহজ-সাবলীল ভাষা। শুধুমাত্র লেখকের লেখনীর দক্ষতায় তা হয়ে উঠেছে স্মৃতিবিজড়িত উপন্যাসের প্লট। উপন্যাসটি পড়ার সময় পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করবে উপন্যাসের কোন চরিত্রে। গল্প শেষ হওয়ার পরও যেন শেষ হয়না, রেশ রয়ে যায়। জীবন এগিয়ে চলে আপন গতিতে; এমনকি কষ্মিনকালও।
ছোট ছোট গল্পের সমন্বয়ে সবার বন্ধুত্বের গল্প, সবার জীবনের গল্প হয়ে উঠেছে দুইশো তেরোর গল্প।
চরিত্রয়ান:
দুইশো তেরোর গল্পের প্রতিটি চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কোনো মূখ্য চরিত্র বা নায়ক-নায়িকা নেই। প্রতিটি চরিত্র তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় উপন্যাসে এনেছে বিস্তৃতি। প্রতিটি চরিত্র তাদের ছোট ছোট গল্পের বুননে ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। লেখক তার লেখনীর দক্ষতায় চরিত্রগুলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পের বুনট আর প্রতিটা চরিত্র খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
উৎসর্গ:
লেখকের প্রিয় দুইশো তেরো নম্বর রুম এবং সকলের ভালোবাসার প্রিয় কষ্মিনকালকে উৎসর্গ করেছেন দুইশো তেরোর গল্প।
প্রচ্ছদ
সানজিদা স্বর্ণা ও তাহমিদ রহমান দুজনে মিলে তৈরি করে ফেলেছেন দৃষ্টিনন্দন এই প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদে প্রথমেই চোখে পড়বে সেই ২১৩ নাম্বার রুম। নামলিপি সুন্দর করে ফুটে উঠেছে প্রচ্ছদে। এছাড়াও হারিয়ে যাওয়া সেই মোবাইল আর সকলের প্রিয় স্মৃতিবিজড়িত সেই ক্যামেরাও রয়েছে প্রচ্ছদে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সময়ের ও ঘটনার সাক্ষী সেই দেয়াল লিখা পুরো কভার জুড়ে। যা প্রচ্ছদে এনেছে এক ভিন্ন মাত্রা। সবমিলিয়ে প্রচ্ছদটি পুরোপুরি উপন্যাস কে উপস্থাপন করেছে যেন কিছু না বলেই।
প্রোডাকশন ও সম্পাদনা:
সতীর্থের প্রোডাকশন ও সম্পাদনা বরাবরের মতোই চমৎকার হয়েছে। কাগজের মান, ছাপা, বাইন্ডিং, বইয়ের কোয়ালিটি, প্রচ্ছদ, বানান সংশোধন খুবই ভালো। খুব যত্ন সহকারে প্রতিটা কাজ নিখুঁত ভাবে করার চেষ্টা করেছে।
প্রিয় উক্তি:
১/ করিডর ধরে একটু পরপর ট্রলি যাওয়ার শব্দ হচ্ছে। ট্রলিতে করে অসুস্থ রোগীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। বাইরে জীবন-মরণের লড়াই হচ্ছে। কেবিনের ভেতর লড়াই হচ্ছে সমাজ আর ধর্মের সাথে প্রেমের। শ্বাশত-সুন্দর প্রেমের লড়াইতে একটু আধটু রক্তক্ষরণের চিহ্ন যেন চোখের পানি, পানিতে আমার হাত ভিজিয়ে দিলে ক্ষতি কী?
২/ মেডিকেল সায়েন্সের এর মাহাত্ম্য এখানেই। এখানে মৃতরা জীবিতদের শিখিয়ে যান।
৩/ আমি ধনুকের মত মেয়ে। এমনিতে ভালো, কিন্তু আমাকে জোর করে বাঁকা করার চেষ্টা করে লাভ নাই, আমি আমার আগের জায়গায় ফিরে আসবোই।
৪/ ভালোবাসার জন্য অনেক কিছু ছেড়ে আসা যায় এটা যেমন সত্যি, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে ভালবাসার দোহাই দিয়ে কাউকে ছাড় দিতে নেই; এটাও সত্যি। আমি তাই আমার সত্যি কে আঁকড়ে ধরে সব ভুলে থাকার চেষ্টা করি।
৫/ কণ্ঠস্বর থাকতেও যারা আজীবন বোবা হয়ে থাকে কিংবা বোবা হয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের মত হতভাগিনী বোধহয় আর কেউ নেই।
৬/ আকাশের সাথে মানুষের যোগাযোগ বোধহয় মাটির সাথে যোগাযোগের চেয়েও দৃঢ়, নইলে মন খারাপ হলেই মানুষ আকাশ দেখবে কেন?
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....