কাব্য অসুখ By সাবের চৌধুরী

কাব্য অসুখ By সাবের চৌধুরী

কৈশোর পেরোনোর সময়টিতে কবিতার গভীরতর শব্দাবলি আমাকে যেরকম সচকিত করে তুলেছিল, এর খানিকটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো তারুণ্যের শুরুর সময়টিতেও। কবিতা লিখব—ভিতরে এমন একটি ইচ্ছা, স্ফূর্তি ও মানসিক প্রস্তুতি টের পাওয়ার পর খুব গোপনে আনন্দিত হয়ে উঠলাম। আমার পছন্দের শরীর ছিল প্রধানত গদ্যকবিতা। কবিতায় ছন্দবদ্ধ শরীরটাই মূল এবং কবিত্ব প্রকাশের আসল জায়গা—এটুকু বিশ্বাস করেও আমি একজন সম্ভাব্য কবি হিসেবে নিজেকে সমর্পিত করেছিলাম গদ্যকবিতার কাছে, এর পেছনে কারণ কী ছিল তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। অনুমান করি, ছন্দ ব্যাপারটা বুঝার জন্য যে পরিশ্রমের ভিতর দিয়ে যেতে হবে, সেটুকু নিতে চাচ্ছিলাম না। সাথে একটা সন্দেহও দানা বেঁধেছিল যে, ছন্দে হৃদয় উন্মোচিত হয় কম, একটা মেকি পরিশীলতায় বন্দি হয়ে হৃদয় তার নিজস্ব সরলতাটি হারিয়ে ফেলে। বিপরীতে হৃদয়কে তার সমস্ত আকুতি ও ইচ্ছাকে সহজভাবে ধারণ করার জন্য গদ্যকবিতায় যেমন দশদিগন্ত অবারিত হয়ে থাকে, তা আমাকে আকর্ষণ করেছিল প্রবলভাবে। যদিও পরবর্তী সময়ে ছন্দ বিষয়টা বুঝার পর মনে হয়েছে বাইরে থেকে এভাবে বিচার করলে ছন্দের প্রতি কিছুটা অবিচারই হয়। কারণ, যেটুকু বুঝতে পেরেছি, কবিতার জন্য ছন্দ বিষয়টা মেকিভাবে আরোপিত কিছু নয়। কবিহৃদয় যখন প্রেমাকুল হয়ে ওঠে, তখন তার ভিতরে স্বাভাবিকভাবেই একটি কাব্যিক ছন্দ বিকশিত হয়। কবি শুধু তন্ময় হয়ে সেটুকু উৎকীর্ণ করে তোলেন হরফের বন্ধনীতে। তবু শেষ পর্যন্ত বিষয়টা খুব সহজ কিছু নয়। এখানে অর্জন ও সাধনার বিষয় আছে। আমি সেদিকে যেতে চাচ্ছিলাম না। আমার মনে আছে, তারুণ্যের সে শুরুর সময়টিতে আচ্ছন্নতা এতটাই প্রবল ছিল যে, আমার প্রাত্যহিক জীবন, চলাচল, ছবি ও দৃশ্য, ভাবনা ও কথা—সকল কিছুই একটা কাব্যিক ভাবসমৃদ্ধতায় বিগলিত হয়ে মাথার ভিতর সশব্দে প্রবাহিত হতে শুরু করল। সে সময়টিতে বেশ কিছু কবিতা আমি লিখেছি এবং কিছুকাল পরই টের পেলাম কবিতার নাম দিয়ে আমি অত্যন্ত লজ্জাষ্কর জিনিসই উৎপাদন করছি কেবল। না, অশ্লীল কিছু লিখিনি। লজ্জাষ্কর এ জন্য যে, আমি কবিতাকে যে উচ্চ জায়গা থেকে কল্পনা করি, যে গভীরতা ও রহস্যের কূটাভাসে বিরচিত হতে দেখতাম কবিদের লেখায়, সে তুলনায় আমার কবিতাগুলো ছিল সামন্যতর। এর কিছুদিন পরই বলতে গেলে কবিতার কাছে অনেকটা অপদস্থ হয়ে সে নেশা পরিত্যাগ করলাম এবং নিজেকে ব্যর্থতার মনঃপীড়া থেকে মুক্তি দিতে নিজের ভেতর সান্ত্বনামূলক সুন্দর একটি বাক্য তৈরি করলাম: আমার ভিতরে কাব্যযন্ত্রণা আছে; কিন্তু একে প্রকাশ করবার ভাষা আমাকে দেওয়া হয়নি। এ নিরেট সান্ত্বনা-বাক্যও ছিল না। বাক্যটির মর্মমূলে খানিকটা সত্যের সুগন্ধিও লেগে আছে। সে উপলব্ধিটি বলি। কিন্তু তার আগে ছোট একটা দ্বন্দ্বের নিরসন করা দরকার। যেটা বলতে যাচ্ছি, একে কি উপলব্ধি বলা যাবে? এর বিকল্প হিসেবে আমার হাতে আরেকটি শব্দ আছে—অনুমান। উপলব্ধি ও অনুমান শব্দ দুটির মধ্যে ফারাক কতটুকু কে জানে। শব্দের শরীরে যে গন্ধ থাকে, সে থেকে বোধ করি অনুমান শব্দের ভিতর অনিশ্চয়তার দিকটি কিছুটা প্রবল, সে জন্য এখানে অনুমান ব্যবহারটাই নিরাপদ মনে করছি।

অনুমানটি ছিল এই: কাব্যটা মূলত মানুষের একটা স্বভাবশক্তি। মানুষ একে উপার্জন করতে পারে না; নিয়ে জন্মায়। কিন্তু স্বর্ণ যেমন একটা খনির ভিতরে ধুলোর সাথে মিশে থাকে, সুশোভিত অলংকাররূপে প্রেয়সীর কানে দোল খেতে হলে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া ও বিশুদ্ধকরণের ভিতর দিয়ে যেতে হয়, কবিতার স্বর্ণরেণুগুলোও তেমনি। একে সুন্দর ও মানোত্তীর্ণ কাব্য আকারে হাজির করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন একটি কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যা চরিত্র ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে যেমন বিচিত্র হবে, তেমনি পরিমাণের দিক দিয়ে হবে বিপুল। প্রতিভাবান কবিগণ নির্ঘুম রাত কাটিয়ে যে শব্দ ও দৃশ্য, ইশারা ও চিত্রকল্প, অনুভবের যে সূক্ষ্মতম প্রকাশ কৌশল অঞ্জলি ভরে তুলে আনেন, সেগুলো আমার ব্যক্তিগত দুঃখ ও আনন্দকে স্থিত ও কমণীয় রূপে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। কবিতা নির্মাণের জন্য কাব্যপাঠকে আমি একমাত্র শর্ত বা অবলম্বন হিসেবে দেখাচ্ছি না। তা হবে খুবই হালকা একটি প্রস্তাবনা। বরং আমি নিশ্চিত করেই জানি, শুধু কাব্যপাঠ কাউকে কবি বানাবে না; পাঠের এই অভিজ্ঞতা ছাড়াও কেউ কবি হতে পারে, এবং এটিও স্বীকার করছি কবিতা রূপক অর্থে কিছুটা অলৌকিক ব্যাপার। হয়তো কবি নিজেও টের পান না কীভাবে একটা কবিতা লেখা হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি এ পর্যন্ত যত কবিদের পড়েছি, সবাই কবিতার বিপুল পাঠের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। দেশি ও বিদেশি নানা স্বাদের কবিতায় সমৃদ্ধ করেছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলি। কবিতা একদিকে যেমন অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ভিতরে স্থায়ী একটি ঋদ্ধতা সৃষ্টি করে, তেমনি পাঠ চলাকালীন কোনো কোনো শব্দ দৃশ্য বাক্য কিংবা আস্ত কবিতাটিই নতুন একটি কবিতাকে হৃদয় ও মস্তিষ্কের ভিতর হঠাৎ করে উসকে দেয়। হয়তো ছোট্ট একটা টুকরো দৃশ্যের হাত ধরে আচানক এক আলোর ঝলকানিতে কবি এসে উপনীত হন নতুন কোনো প্রান্তরে। তালাশ করলে এমন অজস্র কবিতা বাংলায় পাওয়া যাবে, যেগুলো নিজের ভিতর ধারণ করে আছে অন্য কোনো কবিতার আস্ত কিংবা খণ্ডিত প্রাণ ও প্রবণতা।

ফলে, একসময় গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, কবিতা নিয়ে আমার ভিতরে প্রাণের যে যন্ত্রণা, একে প্রশমিত করতে হলে নিবিষ্ট ও ঘোরগ্রস্ত হয়ে দীর্ঘ পাঠ গ্রহণ করার জন্য আমি প্রস্তুত নই। না বৈষয়িকভাবে, না মানসিকভাবে। তাই, খুব দ্রুতই সে পথ পরিত্যাগ করি।

এই বিবরণের ভিতর দিয়ে বাহ্যত নিজেকে একজন সম্ভাব্য কবি হিসেবে আত্মস্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু তেমনটি আমি বুঝাতে চাইনি। কারণ, আমি সম্ভাব্য কোনো কবি কি কবি নই, নিজেকে তো সে পরীক্ষাতেই ফেলিনি কখনো।  

পথ পরিত্যাগ করে এলেও কাব্যের প্রবণতা ও কৌতূহলটি ভিতরে ছিল সবসময়ই। ফলে, লেখার ভিতরে কদাচ দু-তিন লাইন এমন করে ঢুকে পড়ে প্রায়শই, যেগুলোকে আমি সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছি। মনে হয়েছে এ লাইনগুলো গদ্যের সীমানায় ভুল করে ঢুকে পড়া অনুপ্রবেশকারী কেউ। এমনকি কোনো কোনো দিন, যখন বিশেষ কোনো সুখ বা বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, গদ্যের সরল ও ধীর গতিতে কুলিয়ে উঠতে পারি না নিজের সাথে, তখন নির্লজ্জের মতো আবারও গদ্যের সীমানা পেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যাবটা কোথায়? আমি তো পথ বলতে চিনি এই একটিই—গদ্য। তবু, ভুল পথে, অচেনা অন্ধকার কোথাও বোকার মতো গিয়ে উপনীত হই এবং বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ক্ষণকাল। অদ্ভুত এই রচনাগুলোকে কবিতা না বলার মতো প্রয়োজনীয় সচেতনতা আমার আছে, আবার স্বাভাবিক গদ্য যে নয়, সে স্বীকৃতি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। এসব তাহলে কী? আমি জানি না। এটুকু বলা যায়, পুরোনো কাব্য অসুখের উপসর্গ। এসব রচনার ভিতর দিয়ে একজন ব্যর্থ কবির যাত্রাভঙ্গের ইতিহাসটি হয়তো দেখা যাবে, একটু করে, টুকরো দৃশ্যের ভিতর। উদাহরণত দুটো রচনা উল্লেখ করে উপরের বক্তব্যটির সমর্থন হাজির করি:

যদি •
পাতা না কাঁপে যদি আর, যদি না উড়ে পাখি, আচমকা উধাও হয় আকাশের সমস্ত মেঘ, গোধূলি রং; যদি দুপুরের নিঃসঙ্গ আকাশে উড়তে গিয়ে একটা চিল হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটির উপর, শোকাতুর হয়ে সমস্ত নীল নাই-নাই হয় আকাশের—হলদে ফ্যাকাশে হয় রক্তশূন্য মুখের মতন; যদি কোথাও হাসতে গিয়ে কেউ ভুল করে কেঁদে ফেলে, অজস্র স্মৃতির ভারে কোথাও নুয়ে পড়ে সন্তপ্ত আঙুল, কী যেন মনে পড়তে গিয়ে কিছুই মনে পড়ে না আর; যদি অচেনা রক্তিম এক পাথর কুড়িয়ে বিহ্বল হয় কোনো মগ্ন পথিক, গভীর অসমাপ্ততায় পরিব্যপ্ত হয় চরাচর, মুছে যায় গন্তব্য ও অগন্তব্যের ভেদ; এইসব মন খারাপের দিনে যদি এতসব কিছু ঘটে যায়।

বৃষ্টি •
কোথাও বৃষ্টি ঝরে, বহু দূর কোনো বনের ভেতর, আকাশ হতে প্রতিদিন যে শূন্যতা নেমে আসে, ঝরনার জলের মতন, এই কি সচলতা, প্রাণের ধ্বনি, নিঃশ্বাসে শুধু আয়ু ক্ষয়, আমি তার শব্দ শুনতে পাই, চৈত্রের আকাশ, ফাগুনের রোদ, বৈশাখের ঝড়ো হাওয়া আমি সব চিনি, চিনি না শুধু কুয়াশার রাত, কোনো কোনো সন্ধ্যা, পৃথিবী যখন বিব্রত হয়ে গুটিয়ে যায় নিজের ভেতর, ঠিক সে সময় টুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে চৈতন্যে সত্তায়, কাঁপে বুক, আর আমার তখন কিছুই ভালো লাগে না, আমি যদি বলি, দেখো হাওয়া, বোকার মতো হাত বাড়িয়ে বলে, কই, কোথাও তো কিছু নেই, শূন্যতা শুধু, আমি জানি তার মানে, আমি তো শব্দ শুনি না, জলতরঙ্গ মিলিয়ে যাবার ক্ষণে, যেভাবে মিলিয়ে যায় হাসি, এরপর কিছুই থাকে না আর, ক্ষণকাল আগে হেসে ফেলা স্মৃতির আচড়, আমি শুধু দেখি সেইটুকু, জীবনের ভেতর কি অসম্ভব আন্দোলন, গাছের মাথাগুলো নুয়ে পড়ে প্রবল বাতাসে, পাখি ভুলে যায় পথ, কী এক ঘোরের ভেতর অকারণ ঘুরে ঘুরে, কাউকে তো খোঁজে না সে, তবে কেন এই রোদ, এই মেঘের ছায়া, বৃষ্টির ছাট, আমি কিছুই বুঝি না, ছায়ার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর মনে হয় এর বুঝি উৎস নেই, স্বপ্নের বিভ্রমের মতন, বহু দূর ঘুম পেরোনোর পর যখন হঠাৎ মনে হয় এই বেলা ফিরি তবে, তারপর আর কোথাও যেতে পারি না, পথ ভুলে থেকে যাই ঘুমের ভেতর, শুধু স্বপ্ন, দৃশ্যের পর দৃশ্য বদলে যায়, আর অজস্র শব্দের কোলাহলে একটি শব্দই শুধু নেই, নিঃশব্দে যে বৃষ্টি ঝরে, বহু দূর বনের ভেতর, নিশ্চল বৃক্ষের মতন একাকী দাঁড়িয়ে ভিজি, সন্ধ্যায়, দিঘল এই অচেনা রাত!

এই রচনাটির ব্যাপারে যতি সংক্রান্ত একটু কৈফিয়ত বোধ করি দেওয়া দরকার। এলোমেলো এই বাক্যগুলোতে কমার বৃষ্টি ঝরেছে অবিরত। কোথাও কোনো দাঁড়ি নেই, সেমিকোলনও নেই। একদম শেষে শুধু এটা বিস্ময় চিহ্ন। গদ্যের স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী তা নিয়মবহির্ভূত। কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন এর কারণ কী। আমি সুস্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারিনি। শুধু এটুকু বলেছি, আসলে পুরো জিনিসটিকে আমি টের পেয়েছি এভাবেই—দাঁড়িবিহীন, ঘনিষ্ঠ ও নৈকট্যপূর্ণরূপে। নিয়মের দোহাই দিয়ে আমি কি আমার অনুভবকে অস্বীকার করব? নিয়ম মানতে গিয়ে যদি যতি চিহ্নের ছেদ বসাই, এতে ব্যাকরণবিদ্যা হয়তো স্বস্তি পাবে, কিন্তু আমার সে অনুভবের কী হবে?  

কবি হবার পথে না হেঁটে সাহিত্যে দিক বদল করলেও কবিতার কাছে আমি নানা দিক দিয়ে অসম্ভব ঋণী। আমি মনে করি কবিতা একটি সুগন্ধিমতো ব্যাপার। পরিশীলিত সুস্থ ও সুন্দর কবিতা মননশীল মানুষ মাত্রই পাঠ করা উচিত। কবিদের জন্য যেমন, তেমনি গদ্য লেখকদের জন্যও, পাঠ করা উচিত তাদেরও, যারা লেখক নন।

এই লেখায় যত যা দুর্বলতা, সে সমস্ত কিছুর জন্য আমি বিন্দুমাত্র দায়ী নই। এর সমস্ত দায় ওমর আলী আশরাফ নামের ভদ্রলোকটির। তিনি সারা দিন ধরে বন্দু/কের নল তাক করে বসেছিলেন। এমন ভয়ংকর জিনিস মাথার উপরে রেখে আর যাই হোক রচনা সৃষ্টি সম্ভব নয়। কেউ বকা দিতে চাইলে তাকে দিবেন।

সাবের চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ