কখনো হাড় আর কঙ্কাল ছাড়া নিজেকে অথবা মানবদেহকে কল্পনা করে দেখেছেন? কঙ্কাল বাদে কেমন দেখাতো আমাদের? জেলির মতো-অন্য নরম কিছুর মতো? আসলেই তো, শরীরে কঙ্কাল না থাকলে আদৌও কি আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব?
আমাদের শরীরের ত্বক আর পেশি এর অভ্যন্তরে রয়েছে শক্তিশালী এক কঙ্কালতন্ত্র, যা গঠিত মূলত অস্থি আর তরুণাস্থি দিয়ে। মূলত যোজক টিস্যুর একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো হাড়- যা আমাদের শরীরের গঠন এবং সুরক্ষার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাঠনিক সুরক্ষা প্রদান ছাড়াও কঙ্কালতন্ত্র আমাদের শরীরে আরো অনেক কাজ সম্পন্ন করে। মানবদেহে হাড় না থাকার বিষয়টি কল্পনা করা আপনার অযাচিত মনে হতে পারে, তবে এমন অনেক রোগ এর তথ্য আছে- যাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে কঙ্কালতন্ত্র এর কার্যক্ষমতা অনেক কমে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনযাপন যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে যায়।
আমাদের হাড়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানগুলোকে সঞ্চয় করে রাখা। এদের মধ্যে ক্যালসিয়াম আর ফসফরাস অন্যতম অপরিহার্য খনিজ পদার্থ, যা শুধুমাত্র শক্তিশালী এবং সুস্থ্য হাড় এর গঠন বজায় রাখতে সাহায্য করেই না, পাশাপাশি শরীর এবং মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ু যোগাযোগের সুবিধা করে দেয়। ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর রেয়ার ডিসঅর্ডারস (NORD) এর তথ্য মতে, "হাইপোফসফেটাসিয়া" নামক শৈশবে লক্ষণীয় এক ধরণের বিরল রোগ/অবস্থা রয়েছে, যাতে হাড়ের খনিজ সঞ্চয়ের ক্ষমতার জিনগত ত্রুটির কারণে আমাদের হাড় ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফ্র্যাকচারের বা হাড় ভাঙ্গার প্রবণতা তাই অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে।
আবার ভিটামিন ডি এর অভাবে শরীরের দ্বারা ক্যালসিয়াম এর শোষণ একবারে কমে যায়। অতঃপর ক্যালসিয়াম এর অভাবজনিত কারণে ছোটশিশুদের রিকেটস আর প্রাপ্তবয়স্কদের অস্টিওম্যালাশিয়া দেখা দেয়। এসব রোগের কারণে কঙ্কালতন্ত্র এর স্বাভাবিক গঠন ব্যাহত হয় আর হাড়ের দুর্বলতাসহ আরো জটিলতা দেখা যায়।
আমাদের আজকের প্রসঙ্গে আলোকপাত করি। মানুষের কঙ্কালতন্ত্র যদি সম্পূর্ণ রূপে অকার্যকর হয়ে যায় তবে কী হবে? অথবা কঙ্কাল বিহীন একটি শরীরের পরিণতি ই বা কি হতে পারে?
আগেই বলেছি, আমাদের হাড়গুলো শরীরের একটি নির্ধারিত কাঠামো তৈরি করে। তাহলে হাড় বা কঙ্কাল না থাকলে শরীরের নির্দিষ্ট গঠন থাকতো না, যার ফলে মানবদেহের অঙ্গচালনা, স্বাভাবিক কাজকর্ম আর চলাচল করা এককথায় অসম্ভব হয়ে যেত। পেশিসমূহ কঙ্কালতন্ত্রের বিভিন্ন হাড়ের সাথে সংযুক্ত থেকে অঙ্গ চালনা সম্পন্ন করে, যদি হাড় না থাকতো তাহলে পেশিগুলো সংকোচন আর প্রসারণ সঠিকভাবে করতেই পারতো না আর তার ফলস্বরূপ হাটাচলা বা দৈনন্দিন কাজগুলো শরীর করতে পারতো না, হয়তো হাড় ব্যতীত শরীর দেখাতো রক্ত-মাংসের বড় এক পিণ্ডের মতোই!
আবার, হাড় না থাকলে আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমেও তখন নেতিবাচক প্রভাব পড়তো।
যেমন: বুকের পাঁজরের আর কোমরের কশেরুকার হাড়গুলো প্রতিবার শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসের সংকোচন-প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চোয়ালের হাড় আমাদের খাবার চিবানোয় আর গলাধঃকরণে সহায়তা করে, যাতে করে পৌষ্টিকতন্ত্রের কাজ শুরু হতে পারে। মানবমস্তকের হাড়গুলো বায়ুপূর্ণ আর তুলনামূলক হালকা হওয়াতে তা সহজে মস্তিষ্কের ভার বহন করতে পারে- আর অবশ্যই করোটিকার শক্ত গঠন মস্তিষ্কের সুরক্ষা প্রদান করে। মেরুদন্ডের কশেরুকা গুলোর মধ্যে স্পাইনাল কর্ড বা মেরুরজ্জু সুরক্ষিত থাকে। এভাবেই আরো অনেক উপায়ে আমাদের মস্তিষ্কের মতো আরো প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোর সুরক্ষা প্রদান করে হাড় তথা কঙ্কালতন্ত্র। মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্র না থাকলে এসব অঙ্গের কাজ কীভাবে পরিচালনা হতো? হয়তো তখন কাজগুলো সম্পন্ন হতেই পারতো না!
আর মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানসমূহ বেশিরভাগ কঙ্কালেই সঞ্চিত থাকে, তাই কঙ্কালতন্ত্র না থাকলে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমে দরকারি খনিজসমূহ এর ভারসাম্য বজায় থাকবে না। যার ফলে বিভিন্ন শারীরিক আর মানসিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাতে হৃদপিণ্ড আর মস্তিষ্কের কোষে কোষে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে- এমনকি এজন্য মানুষ মারাও যেতে পারে!
আরো কথা আছে। আপনি নিশ্চয়ই "বোন ম্যারো" বা অস্থিমজ্জার কথা শুনেছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের লম্বা, চ্যাপ্টা আর অনিয়ত হাড়গুলোর লাল বোন ম্যারো তে প্রতিনিয়ত রক্তকণিকা উৎপাদন আর রূপান্তর ঘটে-যা আমাদের রক্ত সংবহন তন্ত্রের কারখানার মতোই কাজ করে। যদি শরীরে হাড় না থাকতো, তাহলে প্রয়োজনীয় হারে রক্ত কণিকা তৈরি হতো না! যেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে চিন্তা করুন তো, রক্ত কণিকা তৈরির কারখানা অস্থি আর কঙ্কালতন্ত্রের অনুপস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে!
যাক আপনাদের আর আশঙ্কার কথা না বলি।
মোদ্দাকথা, হাড় তথা কঙ্কালতন্ত্র ছাড়া আমরা আমাদের শরীরের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবো না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, মৃত্যুও হয়তো হানা দিতে পারে! তাই আপনার শরীরের ভেতর শক্ত কঙ্কাল কাঠামো আছে বলে একটি বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই পারেন। - ফাহাদ মান্নান এবং তানহা হোসেন
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....