কোথাও কেউ নেই - প্রথম প্রতিশ্রুতি - সাতকাহন - পাঠ প্রতিক্রিয়া

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের খুব পছন্দের একটা উপন্যাস হচ্ছে সমরেশ মজুমদারের 'সাতকাহন।' যারা ব‌ই পড়ে খুব কম তারাও এইটা পড়েছে। সাতকাহন বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের ঘরে ঘরে থাকে। অবশ্য‌ই এই উপন্যাসটা এটা ডিজার্ভ‌ও করে এবং এটা আমার‌ও ভীষণ পছন্দের।

কিন্তু যদি কেউ বলে সাতকাহনের মতো উপন্যাস আর একটাও হয় না তাহলে তার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করবো। সাতকাহনকে টক্কর দিতে পারে এমন আরেকটা উপন্যাস আছে। সেটা হচ্ছে আশাপূর্ণা দেবীর 'প্রথম প্রতিশ্রুতি।' কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে সাতকাহন যাদের ঘরে ঘরে থাকে তাদের বেশীরভাগ এই উপন্যাসটার নাম‌ও জানে না।

সাতকাহনে দেখা গেছে, দীপা নামের একটা মেয়েকে অল্পবয়সে বাসা থেকে জোর করে বিয়ে দেবার পর বিধবা হয়েও সে ঘুরে দাঁড়ায়। তখনকার সময়ে অসাধ্য সাধন করে দেখায় সে। পড়াশোনা করে সমাজের একেবারে শীর্ষস্থানীয় পদে গিয়ে বসে। বেশীরভাগ মানুষ দীপাকে পছন্দ করে কারণ দীপা কোনোকিছুতেই কম্পোমাইজ করেনি, এমনকি স্বামীর বেলাতেও না। কিন্তু এটা সঠিক তথ্য না। অনেকেই জানে না যে, সাতকাহনের দুইটা এন্ডিং আছে। সমরেশ মজুমদার যখন এটা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছিলেন তখন এটার এন্ডিং একরকম ছিলো। কিন্তু যখন ব‌ই আকারে প্রকাশ করলেন তখন এন্ডিং বদলে দিলেন কি মনে করে। আর এই এন্ডিং‌ই তুলকালাম করলো।‌ সমাজে দুই ধরনের নারী আছে। একদল কম্প্রোমাইজ করে আরেকদল কোনোমতেই করে না। সাতকাহন এই দুই দলের‌ই হৃদয় জিতে নিলো।‌ এটা সমরেশ মজুমদারের একটা চমৎকার ট্রিক ছিলো।

তবে এটা আসলে মুখ্য না যে উপন্যাসের শেষটা কি। উপন্যাসের মাঝে কি এটাই আসল। মাঝে আছে দীপার জীবনযুদ্ধ যেটা মন মানসিকতা বদলে দিতে পারে অনেকের।

সে যাই হোক,উপন্যাসটা যে আসলে অসাধারণ ছিলো তাতে দ্বিমত নেই এবং প্রতিটা মেয়ের যে এটা পড়া উচিত সেটা আলাদা করে বলবো না,বেশীরভাগ মেয়েই সেটা জানে।

এখন আসি প্রথম প্রতিশ্রুতির কথায়।‌ আশাপূর্ণা দেবী একজন নারী ছিলেন,তিনি একজন ফাইটার ছিলেন। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাবার পর সংসারজীবনের যেসব সমস্যা ফেস করেছেন তার কিছুই হারিয়ে যেতে দেননি। তিনি ঘরের সব কাজ শেষ করে রাতে বসে বসে লিখতেন এবং সবাইকে অবাক করে সনাতন মন মানসিকতার এক ঘরের ব‌উ হয়েও লেখালেখিতে গড়ে তোলেন ক্যারিয়ার, জিতে নেন প্রচুর পুরস্কার। 

একজন নারী যখন নারীর গল্প লেখে সেটা সেরা হবার‌ই কথা,পুরুষ থেকে নারী অনেক বেশী জানবে নারীর সমস্যাগুলো। এছাড়াও ওনার লেখার একটা নিজস্বতা আছে এবং সেগুলো অসম্ভব রকমের গভীর। 

প্রথম প্রতিশ্রুতিতে তিনি সত্যবতী নামের একটা মেয়েকে তুলে আনলেন। মেয়েটার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো লেখিকার মতোই। তার বাবা ছিলেন চমৎকার একজন মানুষ।‌ মেয়েকে শুধুমাত্র 'মেয়েমানুষ' হিসেবে দেখতেন না তিনি। তার মেয়ে যে আর দশজনের থেকে আলাদা সেটা তিনি বুঝতেন। এই ব্যাপারে তার প্রশ্রয়‌ও ছিলো।

দীপাবলির লড়াই ছিলো সমাজের সাথে ঘরের বাইরে আর সত্যবতীর লড়াই ছিলো ঘরের মধ্যে। শ্বশুর,শ্বাশুড়ি,স্বামী, আত্নীয়স্বজনসহ সমাজের নাক সিঁটকানো মানুষগুলোর মধ্যে‌ থেকেও সত্যবতী কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি। তার একটা কথা আমার খুব পছন্দের,"মনে জানবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। তোমার যদি মনে হয় তুমি ভুল করছো না তাহলে চারপাশের মানুষ তোমাকে খারাপ বললেও কিছু যায় আসে না। চারপাশের মানুষ খারাপ বলবে এই ভয়ে অন্যায়ের সাথে আপোষ করাটাও তো স্বার্থপরতা। নিজের সুনাম শোনার লোভ। সেটাই কি ভালো?" 

শ্বশুরবাড়ি আসার কিছুদিন পরেই সত্যর শ্বাশুড়ি একদিন সামান্য ব্যাপারে তাকে একটা চড় মেরে বসে। অন্য ব‌উ হলে চুপ করেই থাকতো এবং সহ্য করে যেতো। কিন্তু সত্য তা করেনি। সে প্রথমবারেই প্রতিবাদ করেছে। বলেছে,"আমার গায়ে আর কখনো তুমি হাত দিবে না!"

শ্বাশুড়ি আঁতকে উঠেছে।‌ দশজনের কাছে বলে বেড়িয়েছে, মুখরা ব‌উয়ের যন্ত্রনায় তার টেকা দায়। কিন্তু সত্যর তাতে কিছু যায় আসেনি। কারোর অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে তারপর চুপিচুপি মানুষের কাছে পরনিন্দা করতে যাওয়া সে ঘৃণা করতো। বরং সে অন্যায় দেখলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করেছে মুখের ওপর।

সত্য পড়তো,লিখতো। তার মা একবার তার লেখার খবর পেয়ে ভয় পেয়ে যান। লেখাপড়া শেখা মেয়ে তখন সর্বনাশের সমতুল্য। সত্য বলে ওঠে, "তাই যদি হবে তবে বিদ্যার দেবী সরস্বতী কেন?সেও তো মেয়ে!" এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারেনি শুধু বলতে পেরেছিলো, "বাবাহ! কি মুখরা মেয়ে! হবে না? পড়ে লেখে.."

সত্য তার ছেলেদের জন্য যখন ব‌উ খুঁজছিলো ঘটক এসে এক মেয়ের বিরাট প্রশংসা করে বলে,"খুব ভালো মেয়ে। কচি বয়স, ‌কখনো সূর্যের আলোও তার মুখ দেখেনি।সবসময় ঘরের মধ্যে থাকে আর পড়াশোনা তো একেবারেই করে না!"

ঘটক ভেবেছিলো অন্য সবার মতোই এমন মেয়ে পেয়ে ধন্য হয়ে যাবে এই বৌটিও। কিন্তু সত্য হেসে উঠে উল্টো বলে, "ঐ মেয়ে তোমার কাছেই রাখো। আমার বরং এমন‌ মেয়ে দরকার যে চন্দ্র সূর্যের মুখ দেখেছে, পড়াশোনা জানে এবং একেবারে দুধের শিশু না।" ঘটক‌ও আর সবার মতো ভেবেছিলো এই মহিলা বোধহয় পাগল নাহয় মেমসাহেব।

সত্যবতীর গল্প লেখা হয়েছে দীপাবলির গল্পের‌ও অনেক বছর আগে। সেই সময় সত্যবতী ছেলেদের সাথে কথা বলেছে,একা বাড়ির বাইরে পা রেখেছে, সাহেব ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে, নিজ ধর্মের বাইরে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে জানতে সভায় গেছে, ছাত্রী পড়িয়েছে, স্বামী সন্তান নিয়ে একা কলকাতায় এসে থেকেছে এবং পতিত এক অসহায় মেয়ের গর্ভের অবৈধ সন্তানকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। এই সবগুলো ব্যাপার তখনকার মানুষের কাছে মাথায় বাজ পড়ার থেকেও বিস্ময়কর। 

সত্যবতী যা ভালো বুঝতো করতো,যা খারাপ বুঝতো মুখের ওপর বলতো‌। তার দয়ার শরীর ছিলো,নিজের গায়ের গয়না খুলে পরকে দিয়ে আসতো এদিকে অন্যায় দেখলে একটাবার আপোষ করতো না।

আমাদের দেশের বেশীরভাগ মেয়ের লড়াইই ঘরের মধ্যে।বাইরের লোকের সাথে লড়াই করে জেতা যায় কিন্তু ঘরের আপন লোকের সাথে না। যারা সাতকাহন পড়েছে তাদের এই ব‌ইটাও কি পড়া উচিত না?

আমার আফসোস হয় আমি এটা অনেক দেরীতে পড়েছি। এটা ছোটবেলায় পড়লে নিজের জীবনটা অন্যভাবে পরিচালিত করতাম,সত্যবতীর নীতি আদর্শগুলো কাজে লাগাতাম। আমরা সবাই অনেক আপোষ করি,এই আপোষটা করতাম না।  

এমন না যে এই উপন্যাসটা জনপ্রিয় না। পশ্চিমবঙ্গে এটা যথেষ্ট‌ই আলোচিত।‌ এই উপন্যাসটা রবীন্দ্র পুরস্কার এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা কম‌ই পড়েছে এটা। সাতকাহনের মতো এটাও ডিজার্ভ করে মানুষের ঘরে ঘরে থাকার। 

আমার খুব প্রিয় তিন নারীবাদী উপন্যাসের মধ্যে আছে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি,' 'সাতকাহন' আর 'কোথাও কেউ নেই।' এমন না যে এদের কোনোটা বাদ দেয়া যায় বা ছোট করা যায়। মুনার লড়াই একরকম,দীপাবলির আরেক রকম,সত্যবতীর সম্পূর্ণ আলাদা। নারীবাদ সম্পর্কে আমার ধ্যানধারনা তৈরি হয়েছে এই তিন উপন্যাস থেকে।

মুনার ওপর দায়িত্ব ছিলো মা-বাবা হারা কতগুলো ছোটছোট ভাইবোনের।
সে চাকরি সামলেছে,ভাই-বোন সামলেছে। ভালোবাসার আঘাত,হারাবার বেদনা বুকে চেপে সে ভাইবোনের মুখ চেয়ে বেঁচেছে।

দীপাবলি যখন দেখেছে সমাজে একজন‌ও বিধবা নেই যে অতদূরে গিয়ে পড়াশোনা করেছে,বড় কিছু হয়েছে তখন‌ও সে ভাবেনি,"আর কেউ পারেনি আমিই বা কিভাবে পারবো?" সাদা শাড়ি ছেড়ে রঙ্গিন কাপড় পরে সবাইকে চমকে দিয়ে ব‌ইখাতা নিয়ে কলেজ গেছে সে। ছেলেদের সঙ্গে হেসেছে,গল্প করেছে সবাইকে আঁতকে দিয়ে।

সত্যবতী তার নামের মর্যাদা রেখেছে সবসময়,সত্য বলেছে ও সত্যের পথে চলেছে। মাঝে যারাই এসেছে উপড়ে দিয়েছে।‌ এক পর্যায়ে তারা হাল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে,নত হয়েছে সত্যবতীর সামনে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আত্নসম্মান ছাড়েনি এই মেয়ে।

নারীবাদ মানে লড়াই, সমাজের সাথে নিজের প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়াই। ন্যায় ও সত্যের জন্য লড়াই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন,"যতদিন এই সমাজে নারীকে দ্বিতীয় জীব হিসেবে বিবেচনা করা হবে, সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়।" এই‌ তিন নারী চরিত্র নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের সেরাটা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারী কতটা শক্ত হতে পারে। যতটা মানসিক শক্তি একজন নারী ধারন করে ততটা পুরুষ‌ও করে না। শুধুমাত্র সাতকাহন না, মেয়েদের এই তিন উপন্যাস‌ই পড়া উচিত।

যদিও সময় বদলেছে,যদিও প্রেক্ষাপট আগের মতো নেই তবুও কিছুই কি জানার নেই? সত্যের সাথে লড়াই,অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে এগিয়ে যেতে হলে পেছনের সময়ের এ গল্পগুলো কি সাহায্য করবে না? অবশ্য‌ই করবে। মানুষের দৃশ্যত দুই চোখের বাইরেও চোখ আছে,সেই চোখ সবার ফোটে না।‌ সেই চোখ ফোটাতে পারে এসব উপন্যাস। 

All Rights Reserved - Jannatul Firdous

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ