মৃত লাশ না পচার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা - নিশাত তাসনিম

"পুরানো কবরে অক্ষত লাশ!" শিরোনামের খবর আমরা প্রায়ই দেখেছি। অনেকসময় ৫০/৬০ বছর আগে মারা যাওয়া মানুষের কবর খুড়লে দেখা যায় লাশ পচেনি। তারপর সেই ঘটনাকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। অলৌকিকভাবে এই ঘটনা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এসব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখা কি? চলুন জেনে নেওয়া যাক। 


মৃতদেহ পচার কারণ

মৃত্যুর কয়েক মিনিট পরই মৃতদেহের পচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে শারিরীক কার্যাবলী সচল রাখার জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়।  অক্সিজেনের অভাবে কোষে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে বিষাক্ত উপজাত জমা হয় এবং কোষের অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়। এনজাইম কোষ ঝিল্লী পরিপাক করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে কোষের ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু হয়। একে Autolysis বা Self Digestion বলে। এভাবে দেহের সব টিস্যু ও অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে এবং পচনক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। রক্ত অভিকর্ষের টানে ক্যাপিলারি ও ছোট ছোট শিরায় পৌছায়। কৈশিকজালিকায় রক্ত না পৌছানোর ফলে দেহের রং তখন ফ্যাকাশে দেখায়। হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার পর এন্ডোরফিন ক্ষরণের ফলে দেহের তাপমাত্রা কমে আসে। একে Algor Mortis বলে। 

মানুষের অন্ত্রে থাকে মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া। মৃত্যুর পর এসব ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের বিশাল অংশকে ভক্ষণ করতে শুরু করে এবং অন্ত্রে উপস্থিত অ্যামিনো এসিডকে পচিয়ে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়াকে বলে Putrefying। দুর্গন্ধের প্রভাবে কিছু পরজীবী কীট আকর্ষিত হয়ে পচে যাওয়া টিস্যুতে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফেটে লার্ভা বের হওয়ার পর তারা কয়েক সপ্তাহের মাঝেই দেহের প্রায় অর্ধেক অংশ ভক্ষণ করে ফেলে। মৃত্যুর কিছুদিন পরই সব মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া দেহকে পচানোর কাজে লেগে যায়। মৃত্যুর ৫০ দিন পর বিউটারিক ফার্মেন্টেশন এর ফলে ছত্রাক ও প্রোটোজোয়া আকর্ষণ হয় এবং ভক্ষণ কার্য শুরু করে। এভাবে মৃতজীবী ও মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এর প্রভাবে দেহ পচতে থাকে৷ একসময় মানবদেহের কঙ্কাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।

পচন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের প্রভাব

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার প্রভাবে মৃতদেহের পচন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়। তাপ এর ফলে দেহের জৈব উপাদান দ্রুত ভেঙে পড়ে এবং ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনও দ্রুত হয়। কিন্তু শীতকালে লাশ পচতে সময় লাগে, ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিও কমে যায়। আর লাশ সমাহিত করা হলে কয়েক ইঞ্চি মাটির স্তরের জন্য মাছি বা অন্যান্য কীট ডিম পাড়তে পারেনা। লাশের উপর মাটির পুরুত্ব, মাটির ধরণ ও আদ্রতা ইত্যাদি পচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। মৃত মানুষের দেহ যদি শুষ্ক থাকে তবে পচন প্রক্রিয়া ধীরে হবে, দেহ ভিজা ভিজা অবস্থায় থাকলে পচন দ্রুত হবে। অর্থাৎ লাশ পচার জন্য তাপমাত্রা, অক্সিজেনের পর্যাপ্ততা, ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার, মৃত্যুর কারণ, আদ্রতা, বৃষ্টি, মাটির অম্লতা, কীটপতঙ্গের উপস্থিতি ইত্যাদির অনেকাংশে দায়ী!

মৃতদেহ অক্ষত থাকার কারণ

▪️মৃতদেহ পচার জন্য বড় ভূমিকা পালন করে অনুজীব ও ব্যাকটেরিয়া। অনেক সময় কাদামাটিতে বা এমন স্থানে কবর দেওয়া হয় যেখানে বাতাস, অক্সিজেন পৌছাতে পারেনা। এর ফলে অনুজীব তার ক্রিয়া চালাতে ব্যর্থ হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম ও শুষ্ক পরিবেশে অনুজীবের বিস্তার কমে যায়, এনজাইমের ক্রিয়া ধীরগতিতে হয়। এর ফলে মৃতদেহ সহজে পচেনা। science bee

▪️অনেক সময় মৃতদেহ যে মাটিতে কবর দেওয়া হয় সে মাটির আদ্রতা, ধরণ, আর্সেনিক ও লবণের পরিমাণ পচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। মাটির অতিরিক্ত আর্সেনিক ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ করে এবং মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি থাকলেও মৃতদেহ মমি হয়ে যেতে পারে। মাটিতে লবণ ও আর্সেনিকের উপস্থিতির জন্য কয়েকশত বছর লাশ অক্ষত থাকার নজিরও আছে।

▪️ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ করে অনেক সময় মৃতদেহকে গোসল করিয়ে, কাপড় মুড়ে সমাহিত করা হয়। কাপড় দিয়ে লাশ মুড়িয়ে দেওয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া, অনুজীব, পোকামাকড়ের বিস্তার ধীরগতিতে হয়। মৃতদেহের নাকে তুলা দেওয়া থাকলে মৃত ব্যক্তির নাক দিয়ে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারেনা এবং শরীরের ভিতরের অঙ্গগুলোর বিয়োজন দেরিতে হয় এবং পচন রোধ হয়।

অর্থাৎ, মৃতদেহ অনেক বছর অক্ষত থাকার পিছনে নানা বৈজ্ঞানিক কারণ থাকতে পারে। মৃতদেহের কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেই লাশ না পচার সঠিক কারণ জানা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ