লেখক : সুহান রিজওয়ান
প্রকাশনী : ঐতিহ্য
মূল্য : ৬০০ টাকা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র সমর কুমার চাকমা। দারুণ ফুটবল খেলে সে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় তার খেলা দেখে মুগ্ধ হন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দল মহানগর ক্রীড়াচক্রের কোচ শামীম আজাদ। তাই তিনি সমরকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং নিজের কাছে রেখে গাইড করা শুরু করেন। জাতিগতভাবে বাঙালি না হওয়ার ব্যথা সবসময় ভুগিয়েছে সমরকে। রাঙামাটি শহরে বসবাস করলেও পাহাড়ে বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব সে ভালোভাবেই টের পেয়েছে। সমরের বাবা রতন কুমার চাকমার পিঠে সেনাবাহিনীর বুটের ছাপ সমরকে যেন তাড়া করে ফেরে। তাই ফুটবল খেলার সময় বুট পায়ে দিতে তার বরাবর অস্বস্তি। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকায় আসার পর ক্লাবজীবনে বরাবরই জাতিগত বিদ্বেষের স্বীকার সে। এটাকিং মিডের খেলোয়াড় সমর মাঠে কিংবা তার নিজের জীবনেও ক্রমাগত ট্যাকল কাটিয়ে খেলে যাচ্ছে। মাঠের খেলা কিংবা নিজের জীবন দুইই তাকে হতাশায় ভোগায়।
শামীম আজাদ একসময়ের নামকরা ডিফেন্ডার ছিলেন প্রিমিয়ার লীগে। দেশের হয়ে ছাব্বিশটি ম্যাচও খেলেছিলেন। ঢাকা ইউনাইটেডের গোলকিপারকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু উপরমহলের দুর্নীতির কারণে জুবায়ের আলম তাকে দুই ম্যাচ ইচ্ছাকৃতভাবে হেরে যেতে বলেন, যাতে বিপক্ষ দলের রেলিগেশন আটকে যায়।কিন্তু শামীম আজাদের নৈতিকতা সেটাকে সায় দেয়নি।তিনি খেলেছিলেন নিজের সেরাটা দিয়ে, তার ফলে সেই মৌসুমে আর খেলা হয়নি তার, এমনকি সাফ চ্যাম্পিনশিপে তার খেলার কথা থাকলেও পরে দেখা যায় তার নাম নেই তালিকায়। পরের বছর ঢাকা ইউনাইটেড তাকে কিনলেও একটি ম্যাচও নামায়নি, সেজন্য চলে আসেন মহানগর ক্রীড়াচক্রে। একসময় ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলেও তিনি দায়িত্ব নেন ফুটবলার তৈরির। তারই সূত্র ধরে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ান পাগলাটে অবিবাহিত ফুটবল কোচ শামীম আজাদ এবং পেয়ে যান সমরকে।
শামীম আজাদের বড় ভাগ্নে আরিফ ও তার বন্ধু হিমেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন এর শিক্ষার্থী। সামনেই তাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পরপরই হিমেলের ফার্মে পার্টটাইম কাজ নেয় আরিফ। তাদের কাজ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রিসার্চ করা। এবং একটি প্রজেক্টও পেয়ে যায় তারা। রিসার্সের বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। আমাদের মূল গল্পটা এই শান্তিচুক্তির অতীত ও বর্তমান নিয়েই, যা লেখক দেখিয়েছেন আরিফ ও হিমেলের পার্বত্য অঞ্চলে দেড়মাস তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে।
ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই হ্রদ ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা শুরু করলে লক্ষাধিক আদিবাসী তাদের ভিটেমাটি ছাড়া হয়।অনেকে পাশের দেশ ভারতে চলে যায়, কিন্তু সেখানে গ্রহণযোগ্যতা আবার ফেরত চলে আসে।বসবাস করার জন্য তারা পাহাড়ের আরো ভেতরে চলে যায়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তারা আগে থেকেই দাবি তুলে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষ নিলে পাহাড়িদের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) নেতৃত্ব জাতীয় জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে। '৭৩ এর নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হন।কিন্তু ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং কিছুকাল পরে জেএসএস (জাতীয় জনসংহতি সমিতি) এর সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। পাহাড়ে বিশৃঙ্খলা দিনদিন বাড়ার কারণে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে অপরাগ ছিল পুলিশ ও সামরিক বাহিনী। তাছাড়া ঢাকা হতে পাহাড়ের মধ্যে কি হচ্ছে এসব নিয়ে মাথায় ঘামানোর পরিস্থিতি ছিল না, কারণ তখন দেশের রাজনীতি ছিল দোদুল্যমান।
১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান পাহাড়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জমি এবং টাকা দিয়ে বাঙালিদের বসবাস শুরু করান। এরপর পুরোদমে শুরু হয় বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব। যারই ফলস্বরূপ ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়ায় শান্তিবাহিনীর হাতে চার শতাধিক বাঙালি নিহত হয়, যা পাহাড়ে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। এছাড়া বাঙালি সেটেলাররা বহুবার পাহাড়িদের উচ্ছেদ কিংবা বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, এদিক দিয়ে পাহাড়িরাও শান্তিবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে বাঙালিদের হত্যায় সহায়তা করেছে। জেএসএস দলের মধ্যে লারমা ও প্রীতি গ্রুপের দ্বন্দ্বে একসময় এম এন লারমা নিহত হন এবং দলের দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
বাঙালি - পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, শান্তিবাহিনী-সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ ইত্যাদি নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ১৯৯৭ সালে আওয়ামিলীগ সরকার এবং শান্তিবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি হয় এবং শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। এই শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করা গ্রুপটি পরে ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস থেকে কিছু নেতা বেরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা করেন জেএসএস (সংস্কার/এম এন লারমা) দল। পাহাড়ি তিনটি দলেরই দাবি তাদের শান্তিচুক্তির বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়িত হয়নি।অন্যদিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের বিভক্তি আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের অন্তরায় বলে মনে করা হয়।তবে সরকারের দাবি চুক্তির শর্তগুলো অধিকাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং বাকি শর্তগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আমরা ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, মায়ানমারের জাতিগত নিপীড়নের বিরোধিতা করলেও আমাদের দেশেরই পাহাড়ে কি হচ্ছে সেই বিষয়ে ধারণা নেই। কখনো ভাবিনা যে সাজেক বেড়াতে গিয়ে যে হোটেলে রাত থাকছি সেই হোটেল বানাতে গিয়ে শতাধিক আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। মেজরিটি-মাইনরিটি সমস্যা সৃষ্টির আদিকাল হতে চলে আসছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা কারো হাতেই যদি ক্ষমতা দেয়া হয় তখন হয়তো দেখা যাবে তারাই আবার অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘুদের সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে।
সুহান রিজওয়ান এর সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রান বইটি পড়েছিলাম। সেই ভালো লাগার সুবাদে এই বইটি পড়া। এই বইটিও যথেষ্ট ভালো বই। গল্পের মাধ্যমে নিয়ে গিয়েছেন পাহাড়ঘেরা জনপদে। পাহাড়ের অতীত এবং বর্তমানকে তিনি দেখিয়েছেন স্বচ্ছ আয়নার মতো। গল্পের সাথে সাথে যারা ইতিহাস জানতে চান তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।
ছোট্ট দেশ আমাদের। তবু এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি কত সীমিত। পার্বত্য অঞ্চলের শান্তিচুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে, খুব কম লেখাতেই ঝাপসা ধারণা আসলেও, পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য পদতলে চমকায় মাটি উপন্যাসটি সুহান রিজওয়ানের সার্থক প্রয়াস।
বইটিতে দুটি ধারা এবং দুটি গল্প একসাথে চলেছে। একদিকে নিজের নতুন অনুসন্ধান সমর চাকমাকে নিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজাদের এগিয়ে চলার সংগ্রাম। অন্যদিকে হিমেল এবং আরিফের পার্বত্য অঞ্চলে, পাহাড়ি বাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া।
একদিকে বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাস, অতীত অবস্থা, প্রিমিয়ার লীগের কন্ডিশন, বর্তমান পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন দিক ফুটে এসেছে। এ ধারাটি ফিকশন স্টাইলেই লেখা৷ তাই গতিও ছিল বেশি। পাঠককে ধরে রাখার মত লেখনী, তাই পড়ে যেতেও অসুবিধা হয়নি এবং অত্যন্ত সুখপাঠ্য।
অন্য ধারাটিতে পাহাড়ি মানুষের সংগ্রাম, তাদের অধিকার বঞ্চনা, নিজেদের মধ্যে বিভেদ, পাহাড়ি নেতাদের নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, স্থানীয় রাজনীতি ইত্যাদি দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই অংশ মূলত ফিকশন স্টাইলে নন ফিকশন লেখা।
বলে না, গল্প হতে বাস্তবতা অধিক রোমাঞ্চকর? তাই লক্ষ্য করা যায় এখানে। তবে এই অংশ অনেকটা ধীরগতির। বাস্তবতার সম্মুখীন হলেও, পাঠককে ধরে রাখার মত উপাদান এই অংশে কম। তাই একটানে হয়ত পড়ে ফেলতে পারবেন না, তবে বিরক্ত লাগার আশঙ্কাও কম।
পুরো লেখা কিছুটা ধীরগতির, তবে বিরক্তিকর নয়। লেখকের বর্ণনাভঙ্গিই এজন্য দায়ী অনেকটা। অনেকটা ক্ল্যাসিকাল উপন্যাসের ধারা যেন আছে এখানে। প্রচণ্ড বর্ণনাবহুল লেখা, সংলাপের পরিমাণ কম। লেখায় উপমার ব্যবহার প্রচুর। অনেক সময় সেগুলি যথার্থভাবে ব্যবহৃত, অনেকসময় খাপছাড়া।
লেখকের এই বইয়ের বর্ণনাবহুল লেখনী ভিন্ন ধারার। অনেককে মুগ্ধ করতে পারে, আবার বেশি পেঁচিয়ে টানার জন্য অনেকে বিরক্তও হতে পারে। অনেক সময় নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেছি৷ আবার অনেক সময় বর্ণনায় সূক্ষ্ম কিছু বিষয় তুলে ধরার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি৷
আমাদের সমাজের বেশকিছু অসঙ্গতি সূক্ষ্ম খোঁচার মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন। বর্তমান সামাজিক অবস্থার সম্যক ধারণা বইটি থেকে পাওয়া যাবে। এই বইটিও মাস্ট রিড।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....