'সেলফ ম্যানেজমেন্ট' কেন?
এই একবিংশ শতাব্দীর ব্যস্ততম সময়ে আমাদের বাস। শহরের রাস্তায় বেরুলেই চারপাশের মানুষদের ব্যস্ত পদচারণা চোখে পড়ে। কারো যেন কোনো বিরাম নেই। জীবিকা অর্জনের তাড়নায় এই উন্মত্ত ছুঁটে চলা। ঢাকার ধুলাবালি আর দুষিত বাতাসের সাথে অবধারিত দৈনিক যুদ্ধ করে-করেই আমাদের দিনাতিপাত। তবু এই জীবন যুদ্ধে আমাদের হেরে যাওয়ার অসংখ্য গল্প কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ইতিহাস ব্যর্থ মানুষদের মনে রাখে না। ইতিহাস অতি নির্মম, নির্মোহ। এই টিকে থাকার তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে আমরা অনেক সময় নিজের যত্ন নেওয়া ভুলে যাই। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে যে অসাম্য—তার হিসেব কষতে-কষতে আমরা নির্জিব হয়ে যেতে থাকি, আমাদের আত্মা মরে যেতে থাকে…
.
আমি কে? কিইবা আমার পরিচয়? এই দার্শনিক প্রশ্নের জবাব মানুষ খুঁজে ফিরেছে সমস্ত ইতিহাস জুড়ে। মানুষ কখনো এইসব দার্শনিক প্রশ্নের জবাবের ব্যাপারে একমত হতে পারে নি। কেউকেউ হয়তো নিজেদের মতো করে জবাব বেছে নিয়েছে—আর সে অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়েছে তাদের জীবন। আর যারা পারে নি—তাদের মনোজগতে তৈরি হয়েছে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্ক্ষলা। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে—মানুষের মনোজাগতিক বিশৃঙ্ক্ষলা প্রকান্ড আকার ধারণ করেছে। একে তো পুজিবাদী অর্থব্যবস্থার ফলে তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা থেকে সৃষ্ট হতাশা, তার উপর উত্তরাধুনিক সময়ে তৈরি হওয়া হাজারটা দার্শনিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক মনোজগত হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত।
.
এই অস্থির সময়টায় তাই ইতিহাসের অন্যান্য সময়ের চাইতেও বেশি দরকার ‘সেলফ ম্যানেজমেন্ট’। সেলফ ম্যানেজমেন্ট হলো নিজের মনোজগত ও বহির্জগতকে সুশৃঙ্ক্ষলভাবে সাজানোর কলা। পড়াশোনা বা কাজের বাইরে আমাদের যে অবসর সময়টুকু থাকে—সে একান্ত সময়টুকুকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো গেলে আমাদের জীবনে আসবে স্থীরতা, জীবন আর চিন্তাজগতের নৈরাজ্য কেটে গিয়ে মনে তৈরি হবে ঐকতান আর প্রশান্তি।
.
আমরা এই সিরিজটি অনেকগুলো সেলফ ম্যানেজমেন্ট হ্যাকস দিয়ে সাজিয়েছি—যাতে পাঠকরা সেসব হ্যাকস নিজের জীবনে কাজে লাগানোর মাধ্যমে নিজের মনোজগত ও বহির্জগতে ঐকতান এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারেন।
.
প্রথম প্রশ্নটি করি। আপনার জীবনের লক্ষ্য কী?
.
আমরা একটা সুন্দর শৈশব ও একটা ‘অপ্রত্যাশিত’ শিক্ষাজীবন কাটানো শেষে কোনো একটি চাকরিতে জয়েন করি। ভালো বেতনের চাকরির প্রত্যাশা আর প্রমোশন নামের মুলো ঝুলিয়ে রাখা সিস্টেমের ট্র্যাপে পড়ে আমরা ধীরেধীরে আমাদের শৈশব এবং প্রথম যৌবনের সুন্দর স্বপ্ন আর অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলি। টাকা কামানোর র্যাট-রেসে নেমে আমরা ভুলে যাই আমাদের জীবনের আরো বড় লক্ষ্যের কথা। জীবনের মানে কী? এইযে, খাচ্ছি-দাচ্ছি, অফিস যাচ্ছি আর ঘুমাচ্ছি—এর বাইরে জীবনটা আরো কত বড়ো? একটা জীবন আর্থিকভাবে সচ্ছলতা নিয়ে স্রেফ কাটিয়ে দেওয়াই কী জীবনের উদ্দেশ্য? স্বামী/স্ত্রী, বাচ্চা, সংসারের উন্নতি আর বিনোদনের বাইরে ‘অর্জন করার মতো’ কিছু কি আমাদের জীবনে আছে?
আপনি যদি আপনার অতীতের স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবেন—অবাক হয়ে লক্ষ্য করবেন—অতীতের অনেক স্মৃতিই আপনি ধীরেধীরে ভুলে যাচ্ছেন। স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষকদের নাম আর মনে পড়বে না, অনেক বছর দেখা না হওয়া ক্লাসমেটদের চেহারা ধীরেধীরে ভুলে যেতে থাকবেন, ভুলে যাবেন কৈশোরের ঝড়ের দিনে আম কুড়ানি আর জলায় বাঁধ দিয়ে মাছ ধরার বিচ্ছিন্ন স্মৃতিগুলো। এইযে জীবন, এটা অনেকগুলো সময়ের ক্রমধারা মাত্র। ঘুমোতে যাবার আগের আর পরের সময়। জীবনের সুখ বা দুখের স্মৃতিগুলো ক্রমেই ম্লান হয়ে যায়। অতীতের গত হওয়া আনন্দ বা বেদনাকে একটা সময় আর কিছুই মনে হয়না; কিন্তু আমাদের গত হওয়া ছোটছোট মুহুর্তগুলোতে আমরা যে ছোটছোট সিদ্ধান্তগুলো নিই—সেসবের ফলাফল হয় সুদূর প্রসারী। বলা যায়—অভিষ্যৎ হলো আমাদের বর্তমানের নেয়া অসংখ্য ছোটছোট সিদ্ধান্তের সম্মিলিত ফলাফল। এই ব্যাপারটাকে বলে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। কেউ বাটারফ্লাই ইফেক্ট সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারেন।
.
একজন মানুষের অবচেতনে থাকা ‘জীবনের লক্ষ্য’ তার জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, যা একজন মানুষকে ক্রমান্নয়ে তার লক্ষ্যপানে নিয়ে যায়। এই সিরিজটি থেকে উপকৃত হতে হলে অবশ্যই আপনাকে নিজের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একটি ওয়েল ডিফাইন্ড লক্ষ্য যার আছে—তার জীবন বহুলাংশেই সহজ হয়ে আসে। জীবনের লক্ষ্য থাকা মানুষরা বেশ সহজেই সেলফ ম্যানেজমেন্ট হ্যাকস কাজে লাগিয়ে আরো সাবলীলভাবে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। আমরা পরবর্তী পর্বে ‘কীভাবে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা যায়’—সেব্যাপারে আলোচনা করবো।
(চলবে…)
লিখেছেন—জাহিদ হাসান হৃদয়
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....