শত্রুর সঙ্গে বসবাস : বিদিশা সিদ্দিক | Shotrur Shonge Boshobash

"চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা"
  • বই : শত্রুর সঙ্গে বসবাস
  • কথক : বিদিশা সিদ্দিক
  • লেখক : সাংবাদিক মাসুদ কামাল
  • প্রকাশক : ইজাবেলা উইসন।
  • রিভিউ...
  • আব্দুল্লাহ আল হুমাম 
  • ১৫/১০/২০২২

"আমার ছিল মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল।টানাটানির সংসারে শ্যাম্পু দেওয়ার তো প্রশ্নই উঠেনা,সাবানও ঠিকমত দিতে পারতাম না।আব্বা ছিলেন কবি, তিনি আমাকে একটা কবিতা শেখালেন যা স্কুলে যাওয়ার আগের বয়সেই আমার মুখস্ত হয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা 'বনলতা সেন'। কবিতায় আমার প্রিয় লাইনটি ছিল 'চুল তার কবেকার " বিদিশার" নিশা"। সেখান থেকেই স্কুলে ভর্তির সময় আমার নাম বলি 'বিদিশা'। 

 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিকের মেয়ে দীনা। শৈশব ছিল একদিকে দূরন্ত, চাঞ্চল্য ও দস্যিপনায় ভরপুর অন্যদিকে মায়ের প্রত্যাহিক চুল ধরে বেদম মারধর দীনার জীবনকে করে দিয়েছিল বিতৃষ্ণা। সারাক্ষণ খেলাধুলা, দৌড়-ঝাপ, দোতলা থেকে লাফ দেওয়া, অপরের গাছের ফল চুরি, গাছে উঠা এমনকি সাপের ঘাড় ধরে বাড়ি নিয়া আসার মতো দস্যিপনাও যার মাঝে ছিল। অপরের জানালার কাঁচও ভাঙ্গার অভিযোগ আসতো মায়ের কাছে। বাবা ছিল সংসারের প্রতি অতি-উদাসীন। ফলে অভাব হয়ে যায় নিত্যসঙ্গী সাথে মা'র পক্ষে সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। মা স্বামীর উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে কন্যার উপর তুলে নিত সব। এমন কোন দিন যায়নি যেদিন মায়ের মার পড়েনি পিঠে।এমনকি মা'ই মুখ চেপে রক্ত বার করতেন শাস্তি হিসেবে। 

একসময় পিতা কন্যার উপর স্ত্রীর এ নির্যাতনরোধে ১৪ বছর বয়সী বিদিশাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেন তারই বন্ধু যে দীনার ১৪ বছরের বড়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, যাকে আংকেল বলে সে ডাকতো, ব্রিটিশ নাগরিক 'পিটার উইসন'র সাথে।সে নাম নিয়েছিলো 'পারভেজ আহমেদ'।বাবার ইচ্ছে ছিল পিটার তার মেয়েকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে পড়ালেখা করিয়ে মানুষ করবে। কন্যাবয়সী বিদিশাকে বিয়ে করে পিটার 'বিদ' বলেই সম্বোধন করত। এবার বিদিশাকে সে নিয়ে গেল তার কর্মস্থল সৌদিতে। জেদ্দাতে নেমেই বিদিশার ভাষায়ঃ-
"বিমান থেকে নেমেই পিটার আমাকে তার ব্যাগ থেকে কালো চাদরের মতো কি একটা দিয়ে প্যাকেটের মত করে ঢেকে ফেললো" (বোরকা)।

বিয়ের পর পিটার ঠিকই তার দায়িত্ব পালন করেছে। বিদিশাকে সে পৃথিবীর সেরা ফ্যাশন ডিজাইনের ভার্সিটিতে পড়িয়েছে।তার স্বামী হিসেবে না অভিভাবক হিসেবেই স্কুল পড়ুয়া এক মেয়েকে বিদেশে এনে ভার্সিটির গন্ডি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে,পয়সা খরচ করেছে। যদিও স্কুলের গন্ডিতে থাকতেই তার দুই সন্তান ইজাবেলা ও উইলিয়ামের জন্ম হয়।  

মাঝেমধ্যে মদ খেতো বিদিশা,তবে মদে তার এলার্জী ছিল।একদিন এর প্রতিক্রিয়ায় এমন এক রোগ ধরা পড়লো ডাক্তার তাকে অল্প কিছুদিনেই মারা যাওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছিলো। এরই মাঝে কে একজন আজমীরে খাজা মইনুদ্দীন চিশতীর মাজারে যাওয়ার কথা বলেছিলো। সে সেখানে আসে প্যান্ট শার্ট পড়ে। কিন্তু খাদেম তাকে মা' সম্বোধন করে শালীনতা ও প্রার্থনার কথা জানান। তখন পর্যন্ত বিদিশা নামাজ কি চিনতো না। আল্লাহ রাসুল তো দূরে। ফলে খাদেমের দেখানো নিয়মে সে প্রার্থনা করে আর খাদেম গলায় লাল সুতা বেঁধে দেয়। তার ধারণা অনুযায়ী মৃত্যুপথযাত্রী সে খাজাবাবার কাছে যাওয়ার ফলেই বেঁচে যায়।

স্বামীর অনুপ্রেরণায় এরই মাঝে বিদিশা দেশে বিদেশে ব্যাবসা শুরু করে। বিদেশেও একজন দক্ষ ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে পরিচিতি পায়।বিভিন্ন দেশে ব্যাবসার কারণে তার সফর করা লাগতো। আর তার সন্তান পালতো স্বামী পিটার।বিয়ের পরেও সে বিদিশাকে নাস্তা রেডি করে খাওয়াতো।সে ছিল খুবই উদার,রাত করে বাড়ি ফেরার অনুমতি, রাতে বাইরে থাকার অনুমতি সবকিছুই স্ত্রীকে দিয়েছিল সে।তারা খ্রিস্টধর্ম পালন করলেও বিদিশা ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানতোই না।এ ব্যাপারে পিটারের অথবা বিদিশার পিতার মাথাব্যাথা ছিলনা কখনোই।

এভাবে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ফলে এম্ব্যাসির সঙ্গে তার একটা ভাল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। একদিন কোন এক এম্বাসেডর এর দাওয়াতে এবং বন্ধুর অনুরুধে এম্ব্যাসিতে ডিনার পার্টিতে যায় বিদিশা। সেখানেই তার বন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় 'বিদ, হি ইজ ইউর এক্স প্রেসিডেন্ট, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ,হ্যান্ডশেক করো। হ্যান্ডশেক করলে এরশাদ নিজেকে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ পরিচয় দেয়। এক্স প্রেসিডেন্ট, মিস্টেক ইউ, এরশাদ বলেঃ- 'ওয়ান্স আ প্রেসিডেন্ট, অলওয়েজ প্রেসিডেন্ট। 

সেই থেকে ৭০ বয়সী এরশাদ তার পিছু নেয় তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ার জন্য, এমনকি বিদিশা এমন নারী যে এরশাদকে চড়ও মেরেছিলো তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে। আর এরশাদ ছিল বিদিশার কাছে করুণা ভিখারী।সে হাল ছাড়েনি কখনো।সংসার করার আবেদন জানাতো। একটু সুযোগ চাইত সে।নতুন একটা সংসার আর বংশধর চাইতো।
 
এর মাঝে বিদিশা একদিন রমজানে ইফতারের দাওয়াতে যাওয়ার পথে খুব গুরতর একসিডেন্ট করে শয্যাশায়ী হয়ে যায়। এতে আপনজনরা ছেড়ে গেলেও এরশাদ ছিল পাশে। একমাত্র সেই মাসের পর মাস বিদিশার সেবা করেছে। এতে স্বামীসন্তান থাকা স্বত্তেও বিদিশার মন গলে যায় এরশাদের প্রতি।এরশাদ তার পাশে থেকে পরিশ্রম করে শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। বিপরীতে স্বামী পিটার রুটিনের বাইরে কোন কাজই করত না। এমনকি তার ক্লাস ছিল বলে মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে দেখতেও আসেনি।যদিও বিদিশার পুরো ক্যারিয়ার পিটার গড়ে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত এরশাদ'ই তার মন জয় করে।এরশাদের কথায় পিটারকে ডিভোর্স দিয়ে বন্ধু হয়ে থাকে বিদিশা আর পিটার।পিটার শুধু বলে তোমার জন্য আমার দরজা সবসময়ই খোলা।অন্যদিকে এরশাদ একটি সন্তানের জন্য ছিল আকুল। এমনকি বিদিশার পা ধরে কান্নাকাটির কথাও উল্লেখিত রয়েছে। এরই মাঝে ২০০১সালে নির্বাচনী ঝামেলা আর জেলে থাকতে হয় এরশাদকে।সেই নির্বাচনে ভরাডুবির পর খালেদা জিয়ার ভয়ে লন্ডনে বিদিশাকে নিয়ে আত্মগোপন করে সে। দেশে থাকতেই এরিক জন্ম নেয় আর তাকে লুকিয়ে রেখেছিল বিদিশা তার মায়ের কাছে রাজশাহীতে। কারণ সেটা ফাঁস হলে এরশাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। এরিকের জন্মের বহুদিন পরে বিদিশাকে লিখিত বিয়ে করে এরশাদ। বিদিশার অনেক বিদেশি টাকাও এরশাদ নিয়েছিল। ব্যাবহার করেছিলো।
এরই মাঝে এরশাদের বহু নারীর সাথে সম্পর্কের বিষয়টি বিদিশা প্রমাণসহ পায়।সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ যে কত নারীর সাথেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার বৃত্তান্ত আছে বইতে। এতে তাদের মাঝে ফাটলের সৃষ্টি হয়। এরশাদ বারবার মাফ চেয়েও বিভিন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক রাখতো। বিদিশাকে ধর্মকর্ম শিখিয়েছিলো এরশাদ, তবে নারীর ক্ষেত্রে সে ছিল দুর্বল। সম্পর্ক থাকতোই কয়েক নারীর সাথে তার। এটাই পরে বহু ঝামেলার জন্ম দেয়। পরে ডিভোর্স মামলা পর্যন্ত গড়ায়।
[>মুলত এরশাদ সম্পর্কে জানতেই আমার বইটি পড়া, কারণ একজন পুরুষকে সর্বোত্তম মুল্যায়ন করতে পারে তার স্ত্রী।
বইয়ে বিদিশা দুইটি বিষয় উল্লেখ করেছেন -
১- আমার জীবনে দেশি ও বিদেশী দু'জন স্বামী পেয়েছি। যাদের দুজনকেই আমি একসময় আংকেল সম্বোধন করেছি এবং দুজনের বয়সও ছিল আমার চাইতে দ্বিগুণ।:)

২-"মানুষ আত্মজীবনী লেখে শেষ বয়সে, আমি লিখছি ৩৫ বছর হওয়ার আগেই। যদিও তাতে আমার পুরো জীবন নেই তবে জীবনের একটি বড় অধ্যায় রয়েছে। আর এটা লেখারও আমার কোন প্রয়োজন হতোনা যদি এরশাদের করা মামলায় আমার করুণ জেল নির্যাতনের শিকার হতে না হতো। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আমি নাকি আমার স্বামীর সামান্য মোবাইল আর কিছু গহনা চুরি করেছি।

বিদিশা বলেন:" স্মৃতি প্রতারণা করতে পারে তাই আমি নোট করে রেখেছিলাম এসব।"

>একজন বাঙালি কিশোরী পুরো বিশ্ব ঘুরে কিভাবে ঘরের দুয়ারে আছাড় খায় তার বর্ণনাই হয়ত বইয়ে পাওয়া যাবে।

তবে আত্মজীবনী বলতে মানুষের জীবনের ভাল খারাপ সব গুনেরই উল্লেখ থাকে, সব দিকের উল্লেখ থাকে, সে হিসেবে বিদিশাও তার ব্যাক্তিগত ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কতিপয় দিকও এতে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্যদের মতো নিজেকে ফেরেশতাজ্ঞান করেননি।তবে ধর্ম বিষয়ে তার অজ্ঞতা ব্যাপক ছিল।

সব মিলিয়ে 'জীবন যেখানে যেমন' জানতে বইটি অসাধারণ"!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ