- বই : স্পাই স্টোরিজ
- লেখক : মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
- প্রকাশনী : স্বরে অ
- মূল্য : ২৭০ টাকা
সিনেমায় গোয়েন্দাদের অপারেশনের সাফল্য কিংবা সাহিত্যের পাতায় গোয়েন্দাগিরি আমাদের মনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।তবে বাস্তবজীবনের গোয়েন্দাদের ঘটনাগুলো আরো অবিশ্বাস্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক । একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে শুধুমাত্র অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ করলেই হয় না, এর বাইরেও যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শত্রুপক্ষের শক্তিমত্তা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করা। এর জন্যই দরকার একজন দক্ষ স্পাইয়ের, যিনি কিনা শত্রুর সাথে এক প্লেটে খাবার খাবেন এবং খাবারের বিবরণ জানিয়ে দিবেন তার নিজ পক্ষের কর্তা ব্যক্তিদের।
মোসাদ, কেজিবি, সি আই এ একেকটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা, যাদের অবাধ বিচরণ রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাঝে। এসপিওনাজ জগতের ৬ জন গুরুত্বপূর্ণ অথচ কম আলোচিত স্পাইদের গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা নিয়েই বইটি সাজানো হয়েছে।
অ্যাডলফ তোলকাচভঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীর রাডার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তার হাতে আসে। সোভিয়েত শাসনব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে যোগাযোগ করেন সোভিয়েতের শত্রু আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ এর সাথে। ছয় বছরের এসপিওনাজ জীবনে তিনি পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ২ মিলিয়ন ডলার, অন্যদিকে তার দেয়া তথ্যের বিনিময়ে আমেরিকার সাশ্রয় হয়েছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। যা তাকে 'বিলিয়ন ডলার স্পাই' নামে পরিচিতি এনে দেয়।
ব্রায়ান রিগ্যানঃ বাপেরও বাপ থাকে অর্থাৎ দাদা আরকি। ইনি ছিলেন সি আই এ এর একজন অ্যানালিস্ট, ছিল টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স। যার জন্য খুব সহজেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোপনীয় তথ্য তার হাতের নাগালেই ছিল। খরুচে স্বভাবের হওয়ার কারণে অনেক টাকার ঋণ হয়ে যান তিনি। এছাড়া সহকর্মী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তার সঠিক মূল্যায়ন না করার ক্ষোভ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন শত্রু রাষ্ট্রের কাছে তথ্য বিক্রি করার। লিবিয়ার কাছে প্রথম চেষ্টাতেই তার তথ্যগুলো হাতে পড়ে যায় লিবিয়ার কনস্যুলেটে থাকা এফবিআইয়ের আন্ডারকভার এক এজেন্টের কাছে!
এজেন্ট স্টর্মঃ বিচ্ছিন্ন পরিবারে বেড়ে উঠা এক বিপথগামী সন্তান, যার জীবনের একটি অংশ কেটেছে নেশা, ড্রাগস ব্যবসা এবং চুরি ডাকাতে করে।ইসলাম সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ড্যানিশ পুলিশ এটাকে ভালোভাবে নেয়নি ফলে তার প্রতি আরো শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠে।ইয়েমেনে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসে তার সাথে পরিচয় হয় পরবর্তীতে আল কায়েদার শীর্ষ নেতা আনোয়ার আল-আওলাকি। আফগানিস্তানের জিহাদে যেতে না পেরে স্টর্ম হতাশ হয়ে পড়েন এবং একসময় ইসলাম ত্যাগ করেন। এদিকে আওলাকি এই ব্যাপার জানতেন না এবং স্টর্ম পূর্বের মতই আওলাকির সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যান। আওলাকির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সি আই এ তে একজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করেন।
শুলা কোহেনঃ অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার, চমৎকার হাসি কিংবা মানুষকে আকৃষ্ট করার স্বভাবজাত গুণ ছিল তার মধ্যে। মোসাদের আরেক স্পাই এলি কোহেনের সাথে নামের মিল থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। শুলা কোহেন যখন তার এসপিওনাজ জীবন শুরু করেন তখন মোসাদের জন্ম হয়নি। সবেমাত্র ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসা শুরু করেছে। রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় তার প্রতি কেউ কখনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি। তিনি প্রায় কয়েক হাজার ইহুদিদের লেবাননের মধ্য দিয়ে ইজরায়েলে প্রবেশ করতে সাহায্য করেন যা ছিল ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উপকরণ।
আশরাফ মারোয়ানঃ ইসরায়েলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোয়েন্দা হিসেবে অভিহিত আশরাফ মারোয়ান ছিলেন মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের জামাতা এবং নাসেরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সিনিয়র উপদেষ্টা। উচ্চাকাঙ্খী এবং শ্বশুরের কাছ হতে তার যোগ্য সম্মান না পাওয়াটাই তাকে মোসাদের হয়ে কাজ করার উৎসাহ দেয়। ১৯৭০ হতে ১৯৯৮, দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি মোসাদের হয়ে কাজ করেছেন এবং মোসাদের কাছ হতে নিয়েছিলেন অন্তত ৩০ লাখ ডলার। ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব ইসরায়েল যুদ্ধের ১৫ ঘন্টা আগে মোসাদের কাছে সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা জানিয়ে দেন। তবে আশরাফ মারোয়ানকে অনেকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করেছে, যার ফলে তার মৃত্যুর ঘটনা এখনো অমিমাংসিত রয়ে গেছে।
আনা মন্টেজঃ আনা মন্টেজ ছিলেন ডি আই এর একজন সিনিয়র অ্যানালিস্ট। তার অন্য দুই ভাই-বোনও ছিল এফবিআইতে কর্মরত। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য কিউবার কাছে ফাঁস হওয়ার কারণে তদন্ত শুরু হয়, কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা আনা মন্টেজের নাম দেখে তার বিষয়ে দেখেন যে পুরো ক্লিয়ার। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন নাম আসে তখন তারা পুরোদমে তদন্ত শুরু করে দেয় এবং একসময় তথ্য পাচারের সম্পৃক্ততা পায়। তাকে ধরার জন্য অন্তত ৫০ জন এফবিআই এজেন্টকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমেরিকায় নিযুক্ত কিউবার সবচেয়ে উচ্চপদস্থ স্পাই। তবে তিনি কিউবার থেকে একটি টাকাও নেন নি। বরং তাদের হয়ে কাজ করেছিলেন নিজের নৈতিক দায়িত্ব হতে, আমেরিকার অন্যায় পররাষ্ট্রনীতির খপ্পর হতে কিউবাকে উদ্ধার করতে।
বইটি সত্যিই অসাধারণ। সত্য কাহিনি হলেও বইটা পড়ার সময় একটা থ্রিলার ভাব চলে আসছিল। আর লেখকের বর্ণনার কোনো ঘাটতি নেই, সাবলীলভাবে তিনি বলে গিয়েছেন এসপিওনাজ জগতের ৬ জন স্পাইয়ের জীবনের আলো-অন্ধকারের অধ্যায়।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....