ভূমিধ্বস - অনুপম রায়

ভূমিধস বলতে পাহাড়-পর্বত থেকে মাটির চাকা বা পাথরের খণ্ড বিরাট মাধ্যাকর্ষণ এর টানে নীচে পড়াকে বোঝায়। জল ও মাটি মিশে কাদা আকারে বিপুল পরিমাণে নিচে নেমে আসাও এক ধরনের ভূমিধস।


 

ঢালু স্থানের অস্থিতিশীলতা ভূমিধ্বসের প্রধান কারণ । পাশাপাশি প্রাকৃতিক কারণেও ভুমিধস হয়ে ত্থাকে।গাছপালা কেটে বা আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে ভূমি ক্ষয় হওয়া, নদী বা সমূদ্রের ঢেউয়ের ফলে ভূমিক্ষয়,ভূমিস্থ পানির চাপ,ভূমিকম্পের কারণে ভূমি অস্থিতিশীল হওয়া ভূমিধসের অন্যতম কারণ।

মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলেও ভূমিধ্বস অনেক সময়ে  ঘটে থাকে। 

বর্ষা মৌসুম যতই এগিয়ে আসে, পার্বত্য জেলায় ততই ভূমিধসের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে থাকে । ২০১৭ তে মিয়ানমারের অধিবাসী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে কক্সবাজারের বনভূমি ও পাহাড় ধ্বংস করায় ভূমিধসের আশঙ্কা আরও বেড়েছে।এ কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটিও তোড়জোড় শুরু করেছে। আর পার্বত্য এলাকা পরিদর্শন করে ভূমি ধসের পাঁচটি কারণ জানিয়েছে এ নিয়ে  সাব-কমিটি গঠন করে। একই সঙ্গে ভূমিধস মোকাবেলার জন্য সাতটি সুপারিশ করা হয়। 

১। পাহাড়ে বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষদের জন্য স্থায়ী আবাসন নির্মাণে জায়গা নির্ধারণ
২। রাঙামাটি জেলায় আশ্রয়হীন এবং যারা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে তাদের জন্য ছোট ছোট টিলাগুলো সমতল করে সেখানে তাদের বসবাসের জন্য সরকারি অর্থায়নে স্থায়ীভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ
৩। পাহাড়ের পাদদেশে নতুন করে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ
৪। পাহাড়ে অধিক পরিমাণে পরিবেশবান্ধব এবং পাহাড় রক্ষাকারী বৃক্ষ ও বাঁশ রোপণ
৫। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশের পাহাড়গুলোতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা তৈরির অনুমতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করা এবং বর্তমান স্থাপনাগুলো পর্যায়ক্রমে নিরাপদ ও দূরবর্তী স্থানে স্থানান্তর করা
৬। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ
৭। পাহাড় থেকে মাটি কেটে ও ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা।

ভূমিধসের কিছু বড় বড় ঘটনা আছে .. 

এপ্রিল ১৮, ২০২২
রিও ডি জেনিরোতে একদিনে ছয়মাসের সমান বৃষ্টি হয়। ফেব্রুয়ারিতেই ভূমিধস ও বন্যায় রিও ডি জেনিরোয় ২৪০ জনের মৃত্যু হয়। পর্যটন শহর পারাটিতে ভূমিধসে পাঁচ সন্তান-সহ মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এক দিনে এলাকাটিতে ৩২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

ব্রাজিলের পেট্রোপলিস শহরে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২০০ জন।পেট্রোপলিস শহরে ১৫ ফেব্রুয়ারি,২০২২ এ তিন ঘণ্টার প্রবল বৃষ্টির কারণে এই বিপর্যয় ঘটে।

গাড়ি খুঁটিতে ঝুলে থাকা, গাড়ি উল্টে যাওয়া এবং প্রচুর কাদা ও পানিতে এলাকা ডুবে যাওয়া সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলে। 

এছাড়া প্রবল বর্ষণ ও তার ফলে সৃষ্ট ভূমিধসে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরের ননি জেলার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়। 

যদি আমরা বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তবে দেখা যায়,  অন্যান্ড দেশের মতো বাংলাদেশও এই ভূমিধসের জন্য ক্ষতিগ্রস্হ সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের একটি যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৬ হেক্টর। 

২০১২ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে ভারতের পূর্বাঞ্চল, নেপালের তরাই উপত্যকা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড়ধসের কারণ হিসেবে বনভূমি ধ্বংস হওয়া বা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছে। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ৮ শতাংশ বেড়েছে। এতে পাহাড়গুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বন উজাড় ও পাহাড় কাটার কারণেই ভূমিধস হয়ে থাকে। ভূতাত্ত্বিক গঠনকে আমলে না নিয়ে এবং ধস রোধের কোনো ব্যবস্থাপনা না রেখেই সড়ক নির্মাণ করা - পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতে ভূমিধসের অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভূমিধস হয় ১২ জুন, ২০১৭ সালে। মধ্যরাতে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ১৪৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু রাঙামাটিতেই ১০৫ জন মারা গেছেন।

২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এখানে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে। আর ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে। এর ফলে এই অঞ্চলের পাহাড়ের মাটির বুনন নষ্ট হয়ে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। একই সময়ে ২৮.০৫ শতাংশ কৃষিজমি বেড়েছে যা সিইজিআইএস এবং ওয়াটারএইডের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে।

অনুপম রায় 
ভলেন্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ