মানুষ তোমাকে ভালোবাসবেই - শিহাব আহমেদ তুহিন

এক.
পশ্চিমা দেশের একটি ভার্সিটি। সেখানে সবাই বেশ খোলামেলা কাপড় পরে। এর মধ্যে হুট করে এক মেয়ে উদয় হলো, যে নিকাব পরে ক্লাসে আসে। তবে এভাবে আসাটা একেবারে সহজে হয় না। বেশ টিটকারি হজম করতে হয়। চলে নানা তির্যক মন্তব্য।



তবে পেছনে পেছনে ক্লাসমেটগুলো ঠিকই মেয়েটার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। এই যুগে উঠতি বয়সের এক মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই, ড্রিংকস করে না, নাইটক্লাবে যায় না—কীভাবে সম্ভব! এ মেয়ে পৃথিবীর নাকি মঙ্গল গ্রহের! সামনে যত বৈরিতাই দেখাক না কেন, পেছনে পেছনে ঠিকই তার প্রশংসা করতে বাধ্য হতো ওরা। বাধ্য হতো ওকে পছন্দ করতে।

ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। যখন কেউ সত্যিই আল্লাহকে ভয় করে চলে, তার রবকে ভালোবাসে, আল্লাহ তখন মানুষের মনে তার জন্যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ঢেলে দেন। তার বিরোধীদের কথা শুনলে হয়তো সেখানে বাহ্যত ঘৃণার উদ্গিরণ দেখা যাবে, তারা তাকে তার ঈমানের কারণে বন্দি করতে চাইবে, হত্যা করতে চাইবে; কিন্তু মনে মনে ঠিকই তারা সে লোকের জন্য শ্রদ্ধা রেখে চলবে। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর চেয়েও তার কথাকে বেশি বিশ্বাস করবে। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) তাই উল্লেখ করেছেন—

‘যে আল্লাহকে ভয় করে, মানুষ তাকে ভালোবাসবেই। এমনকি ভালোবাসতে অপছন্দ করলেও তাকে ভালোবাসবে।’

এ বিষয়ে খুব সুন্দর একটি হাদীস রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন— 

‘যখন আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তিনি জিবারাইলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তাই তুমিও তাকে ভালোবাসো। তখন জিবারাইলও তাকে ভালোবাসেন। আর জিবরাইল তখন আসমানবাসীদের বলেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, তাই (এখন থেকে) তোমরাও তাকে ভালোবাসবে। ফলে সমগ্র আসমানবাসী সে লোককে ভালোবাসতে শুরু করে। এরপর পৃথিবীবাসীর নিকটে তার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়।’ 

যে মেয়েটার গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটি এক শায়খের কাছ থেকে শোনা। গল্পের শেষটা বেশ হতাশার। মেয়েটা ক্লাসমেটদের কাছ থেকে টিটকারি শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে একদিন পর্দা ছাড়াই ওয়েস্টার্ন পোশাকে ভার্সিটিতে চলে গেল। ওর ক্লাসমেটরা তো হতভম্ব। মেয়েটা আশা করেছিল, সবাই ওকে এভাবে দেখে ওর রূপের প্রশংসা করবে। এসব ‘নিনজা-মার্কা ড্রেস’ ছাড়ার কারণে ওর সাথে ভালোভাবে মিশবে।

তবে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। ক্লাসমেটদের বেশ বড় একটা গ্রুপ ওর কাছে গেল। বলল, তুমি কি জানো, সামনে যা-ই বলি না কেন, ভেতরে ভেতরে আমরা তোমাকে অনেক সম্মান করতাম? তোমার সুন্দর আচরণ দেখে মুগ্ধ হতাম? অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ, আমরা ভেবেছিলাম ইসলামের কারণেই তুমি এত আলাদা। এত ভালো। কিন্তু এখন সে সিদ্ধান্ত বাদ দিয়েছি। কারণ, যে ধর্ম সামান্য কিছু সময় তোমাকে ভালো রাখতে পারল না, সেটা আমাদের কীভাবে সারাজীবন ভালো রাখবে?                          

দুই.
ভার্সিটি লাইফের শেষরাতে আমি জুনিয়রদের একটা কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম—কখনো তোমাদের দীনের ব্যাপারে ছাড় দেবে না। মানুষ যত সুন্দর করে কথা বলুক আর যত উগ্রভাবেই বলুক। তোমাকে ওরা এসে বলবে, ‘চলো একটু ট্যুরে যাই, নাইট প্রোগ্রামে যাই, ক্লাসপার্টিতে যাই। তুমি মেয়েদের সাথে থাকলা না, সমস্যা কী? আমাদের সাথে থাকবা। আর নামাযের সময় হলে নামায পড়তে চলে যাবা।’

তুমি যদি ওদের কথা শুনে ওসব ফিতনার জায়গায় যাও, ওরা খুশি হবে। কিন্তু মনে মনে ভাববে, ওর মধ্যে ভেজাল আছে। না হলে হুজুর হয়ে এসব জায়গায় থাকে কীভাবে? 

আর যদি তুমি ওদের না করে দাও, ওরা হয়তো খুব মন খারাপের ভাব দেখিয়ে চলে যাবে। কিন্তু অন্তর থেকে তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। যারা চিন্তা করতে জানে, তারা তোমার এমন আচরণ নিয়ে ভাববে। কে জানে! একদিন নিজেই হয়তো এসব ভাবতে ভাবতে সে হিদায়াত পেয়ে যাবে।

তারা ভালো আচরণ করুক কিংবা খারাপ; বন্ধু হোক বা শত্রু, তারা আমাদের গভীরভাবে দেখছে। যদি নিজের জন্যে ভালো থাকতে ইচ্ছে না করে, আল্লাহর দীনের জন্য অন্তত আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করতে পারি।

ওরা যা-ই বলুক, কখনো নিজেদের ইনফিরিওর ভাববেন না। আপনার কাছে আল্লাহর দীন রয়েছে। ভার্সিটিতে যেসব মাঠ কাঁপানো, অডিটোরিয়াম ঝাঁকানো, সিজি কোপানো তথাকথিত লিজেন্ড আছে, আপনি তাদের চেয়ে অনেক বেশি লিজেন্ড, অনেক বেশি সম্মানিত—যদি আপনার মধ্যে তাকওয়া থাকে।

ওরা আপনাকে নিয়ে উপহাস করে। জঙ্গি, ক্ষ্যাত, কাঠমোল্লা—বলে। কিন্তু হারামের সাথে রাতদিন কাটিয়ে যখন হাঁপিয়ে ওঠে, তখন ঠিকই ওদের ইচ্ছে করে ভালো হয়ে যেতে। আপনার মতো হুজুর হয়ে যেতে। জেনে রাখুন, যদি আল্লাহকে ভয় করে চলেন, তবে তিনি ওদের অন্তরে আপনার জন্য শ্রদ্ধার বীজ বুনে দেবেন।

সে বীজ যাতে ইসলাম নামক মহিরুহে পরিণত হয়, সেটার জন্য হলেও আপনাকে ভালো থাকতে হবে।

লিখেছেন : শিহাব আহমেদ তুহিন
বই : চয়ন
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ