- বই : অপেক্ষা
- লেখক : হুমায়ূন আহমেদ
- জনরা : সামাজিক
কাহিনী সংক্ষেপ : অপেক্ষা উপন্যাস টি শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের লেখা আর পাঁচটা গল্পের মত খুবই সাদামাটা ভাবে। কিন্তু লেখকের অনবদ্য লেখন-শৈলী খুব সাধারণ গল্পটিতে এনে দেয় নতুনত্ব, গল্পটি পড়ার অকৃত্রিম আগ্রহ ও চরিত্র গুলোর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা। অপেক্ষা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইমন ও তার মা সুরাইয়াকে নিয়ে পুরো উপন্যাস টা লেখা হয়েছে। সুরাইয়া তার স্বামী আর পাঁচ বছরের ছেলে ইমনকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। তাদের সাথে থাকে ইমনের ছোট চাচা ফিরোজ।
ঢাকায় ১৫-২০ দিনের জন্য বেড়াতে আসতেন ইমনের দাদি। গ্রামের সহজ সরল মানুষ ইমনের দাদি ইমনকে আদর করে ডাকতেন ইমইন্না। দাদির সাথে গল্প করতে ইমনের ভালো লাগতো। একদিন রাতে ইমনের বাবা ফিরতে দেরি করেন। রাত বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়ে সুরাইয়ার দুশ্চিন্তা।আর এই দুশ্চিন্তা থেকে শুরু হয় ইমনের মা সুরাইয়ার স্বামীর জন্য অপেক্ষা। একজন জীবিত মানুষের জন্য অপেক্ষা করা যায়। তবে মৃত মানুষের জন্য অপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু সুরাইয়া কখনই তার স্বামীকে মৃত হিসেবে মানে না। তার অপেক্ষা চলতে থাকে দিনের পর দিন।
সাধারণত আমরা প্রিয় মানুষ কিংবা প্রিয় বস্তুর জন্য অপেক্ষা করতে পছন্দ করি না। কিন্তু কখনো কখনো প্রিয় জিনিসটার জন্য আমরা অবিরাম অপেক্ষা করি। এমনকি এই অপেক্ষা করার মাত্রাই একদিন আমাদের বাধ্য করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে। আর ঠিক এটাই ঘটেছে ইমনের মা সুরাইয়ার সাথে। তার অস্বাভাবিক জীবনযাপন চলতে থাকে অবিরত।
সুরাইয়ার অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয় তার ছেলে ইমন এবং সেই সাথে তার ছোট্ট মেয়ে সুপ্রভা। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে করা সবচেয়ে বড় ভুলটি তার জীবন থেকে সবচেয়ে বড় জিনিসটাই কেড়ে নেয়। তা হলো বেঁচে থাকার সুযোগ। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে কে হারালো বাঁচার সুযোগ? কে দিল তার অকাল জীবন? কেই বা ভেঙ্গে পড়ল মানসিক যন্ত্রণায়? বাবার জন্য করা ইমনের অপেক্ষা কি শেষ হয়েছিল? শেষ পর্যন্ত সুরাইয়া কি পেয়েছিল নিখোঁজ স্বামীর দেখা?
চরিত্র বিশ্লেষণ : হুমায়ূন আহমেদ নিজে যেমন অনন্য সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তেমনি তার সৃষ্টির প্রায় সব কয়টি চরিত্রই ভারী অদ্ভুত প্রকৃতির হয়। চরিত্র নির্মাণের বৈচিত্র্যতা ধরে রেখে হুমায়ূন আহমেদ অপেক্ষা উপন্যাসে বেশ যত্ন করেই সৃষ্টি করেছেন প্রতিটি চরিত্র। অপেক্ষা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইমন, তার মা সুরাইয়া, বোন সুপ্রভা ও চাচা ফিরোজ সহ আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো -
ইমন : ইমন চরিত্র টা তার নামের মত সাধারন হতে পারতো। তা না হয়ে ছোট থেকেই ইমন ছিল গুরুগম্ভীর। তাকে কখনো কখনো খুব বুদ্ধিমান মনে হলেও ভেতর থেকে ছিলেন ভীষণ ভীতু। অথচ যতই বড় হয়েছে ততই চারপাশের মানুষের সাথে অদ্ভুত রকম দূরত্ব তৈরি হয়েছে। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ ও অমানসিক নির্যাতন, অসহ্যকর কার্যকলাপ সহ্য করতে করতে বড় হয়েছে ইমন। মায়ের ভালোবাসা পাবার তীব্র ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে দূর থেকে কামনা করেছে মা যেন ছোট্ট বোন সুপ্রভার প্রতি কোন অবহেলা না করেন। অথচ মায়ের যত রাগ ছিল সুপ্রভার উপর।
বাবাকে হারিয়ে মায়ের পাগল প্রায় অবস্থা শিশু ইমনকে মানসিকভাবে অনেক কষ্ট দিত। তবুও সে সময় নিজেকে সামলে নিতেন। কেবল ছোট চাচা ফিরোজের অকৃত্তিম স্নেহ-ভালবাসা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল অনেককাল। চারপাশের প্রতিটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা, মায়ের মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন, ভাগ্যের নির্মম পরিণতি, বাবার চিরতরে নিখোঁজ হওয়া প্রভৃতি বিষয় গম্ভীর ইমনকে ধীরে ধীরে আরো গুরুগম্ভীর মানুষে রুপান্তর করে। তার কেবলই মনে হয় মায়ের ভাবনাকে সত্যি করে বাবা যদি সত্যি সত্যি ফিরে আসত তার জীবনে এসব কিছুই হত না।
পুরো গল্পের মধ্যে এই ইমন চরিত্রটি আমাকে সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছে। তার মানসিক কষ্টগুলো উপলব্ধি করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে ছোটদের ছোট ছোট ব্যথাগুলোই তাদের জীবনে বড় বড় বাধা সৃষ্টি করে পুরো জীবনটাকে ভঙ্গুর করে তোলে।
সুরাইয়া : আমরা কেবল মুখে 'ভালবাসি' বলায় বিশ্বাসী। কেবল মুখে 'ভালবাসি' বললেই ধরে নেই এটাই 'ভালোবাসা'। অথচ ভালোবাসার মানুষকে সত্যিকারের মতো ভালোবেসে দিনের পর দিন তার জন্য অপেক্ষা করার মাঝে যে অপরিসীম ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, তা সুরাইয়া চরিত্রটিকে পড়লে বোঝা যায়। অপেক্ষা গল্পের সবচেয়ে অদ্ভুত, পাগলাটে, অস্বাভাবিক, জেদি ও দুঃখী চরিত্র সুরাইয়া। স্বামীর মৃত্যুকে সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। তার ধারণা, তার স্বামী একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন।
এক পীরের কথা : সুরাইয়ার ছেলে ইমন বিয়ে করলে ইমনের বাসর রাতের দিন তার স্বামী ফিরে আসবে।
সুরাইয়াকে পড়ার সময় আমার মনে হতো সে অনেক বাড়াবাড়ি রকম খারাপ ব্যবহার করছে। পরক্ষণে আবার মনে হতো, যে পাথর সমান দুঃখ নিয়ে সুরাইয়া বেঁচে আছে। তাতে তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া আর সব বিষয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করাই স্বাভাবিক। একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে প্রচন্ড পরিমাণ ভালবাসার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বহিঃপ্রকাশ দিনের পর দিন সুরাইয়ার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করা।
ফিরোজ (ছোট চাচা) : ইমনের ছোটবেলার খেলার সঙ্গী কিংবা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলেন তার ছোট চাচা ফিরোজ। বাবাকে হারিয়ে মা যখন পাগল প্রায়। তখন ইমনের ছোট বড় সব সমস্যার সমাধান দিয়ে পাশে থাকতো ছোট চাচা। ছোট চাচাই একমাত্র মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তখন যখন ইমন বড় কোন বিপদে পড়ে। ছোট চাচা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের জেদের কারণে ইমনরা যখন বাড়ি ছেড়ে তার বড় মামার বাড়িতে চলে যায়। ইমন ছোট চাচার গলা জড়িয়ে অনেক কাঁদে। মামার বাড়িতে থাকতে গিয়ে পদে পদে টের পায় কেবল ছোট চাচাই পারে ইমনের সব সমস্যার সমাধান দিতে।
ইমনের ভবঘুরের স্বভাবের ছোট চাচা ফিরোজ কোনদিন বিয়ে করেনি। ছোট চাচা জীবনে কোনদিন সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছি কিনা ইমন জানে না। ইমন শুধু জানে এই পৃথিবীতে কেবল এই একটা মানুষ তাকে প্রচন্ড পরিমাণ ভালোবাসে।বাবার অবর্তমানে ছোট চাচাই তাকে আদর স্নেহ দিয়ে আগলে রাখে। মামার বাড়িতে চলে গেলেও ছোট চাচা তাদের ভুলে যায়নি। ইমন জানতো তার বিপদের কথা শুনলে তার ছোট চাচা কখনোই তাকে একা ফেলে যাবে না। ছোট চাচা কে সে প্রচন্ড পরিমাণ ভালোবাসত এটা ইমন বুঝত। সে আরো বুঝতো তার জীবনে সব সময় যদি ছোট চাচা থাকতো। তাহলে হয়তো তার অসহ্য কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা কমে যেত।
অপেক্ষা গল্পের ইমন চরিত্রটির পর আমার ছোট চাচার চরিত্রটি ভীষণ ভালো লেগেছে। ছোট চাচা ফিরোজ একমাত্র মানুষ যে ইমনকে পুরোপুরি বুঝত। ভালবেসে ছোট চাচা ইমনকে 'হার্ড নাট' বলে ডাকতো।
সুপ্রভা : বাবা নিখোঁজ হবার পর জীবন নিয়ে দিশেহারা হয়ে যাওয়া ইমন, তার মা আর ছোট চাচা যখন দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। তখনই তাদের জীবনে আসে ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে সুপ্রভা। মায়ের খামখেয়ালিপোনা ও সূক্ষ্ম অবহেলা কে উপেক্ষা করে বেড়ে ওঠে ছোট্ট মেয়েটি। সহজ সরল মনের সুপ্রভা কে ইমনের পাশাপাশি খুব ভালবাসত তাদের বড় মামা। যাদের বাড়িতে জন্মের পর থেকে তারা থাকছে। সেই বাড়ির কর্তা সুপ্রভার মামা বেশ ব্যস্ত মানুষ। ব্যবসায়ের কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে যে স্ত্রী সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। অথচ তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সুপ্রভা। সুপ্রভাকে তার বড় ভাই ইমন যেমন বড় ভাই হিসেবে ভালোবাসতো। সুপ্রভাও তার ভাই ইমনকে ভালোবাসত। ভালোবাসত বলেই ভাইয়ের গুরুগম্ভীর চেহারা আর অদ্ভুত চুপ থাকার স্বভাব দুই ভাই বোনের মাঝে কখনই দেয়াল তুলে দেয়নি।
মাঝে মাঝে মামি ফাতেমার কটু কথা শুনতে হলেও মামার কাছে বড় আদরের ছিল সুপ্রভা। তার প্রতি মামার দুর্বলতা মামা কখনো প্রকাশ করতে না পারলেও কাজে কর্মে তা প্রকাশ করতেন। সুপ্রভার জন্যই মামা অফিসে একটি ফ্রিজ রেখেছিলেন। কেবল সুপ্রভা ঠান্ডা কোক পছন্দ করত বলে মামা ফ্রীজ ভর্তি কোকের ক্যান সাজিয়ে রাখত। মামার এই কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তিনি সুপ্রভা কে কতটা স্নেহ করতেন!
অপেক্ষা উপন্যাসে যেখানে একাধিকবার জটিল চরিত্রগুলো যত্নের সাথে নিজেদের ভূমিকা পালন করেছিল। সেখানে সুপ্রভা চরিত্রটি ছিল সবচেয়ে নিষ্পাপ, লাজুক, সহজ-সরল মন মানসিকতার। চারপাশের প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে অদ্ভুত ভাবে দাগ কা/টা মেয়েটির করুণ পরিণতি আমাকে ভীষণ ভাবে আঘাত করেছিল। যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল সুপ্রভার মামা ও তার বড় ভাই ইমন।
বড় মামা : গম্ভীর মুখের স্বল্পভাষী ইমন ও সুপ্রভার মামা, সুরিয়ার বড় ভাই জামিলুর রহমান ছিলেন মিতু ও টোকন-শোভনের বাবা, ফাতেমার স্বামী। সারা জীবন ব্যবসায় ডুবে থেকে তিনি পারেননি পরিবারে মানুষের প্রতি মনোযোগ দিতে। পারেননি প্রত্যেকের সমস্যার সমাধান করতে। অথচ এই মানুষটি কিনা একমাত্র আদরের ভাগ্নি সুপ্রভার জন্যই অফিসে ফ্রিজ কিনেছিলেন। সুপ্রভা সময়ে অসময়ে তার অফিসে এলে কোক খেতে চাইত। অসময়ে তার অফিসে আসার কারণে সুপ্রভাকে বকতেন ঠিকই। মনে মনে খুশিও হতেন। নিজের ভেতরকার কোমলতাকে বাহিরের কাঠিন্যের কারণে প্রকাশ করতে না পারলেও মামা জামিলুর রহমান সুপ্রভাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন।
সুপ্রভাই একমাত্র মানুষ যাকে মামা জামিলুর রহমান সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। ছোট্ট সুপ্রভা মামার কাছে কোন আবদার করলে তিনি ফেরাতেন না। হোক সেটা ঠান্ডা কোকের কিংবা ফেল করার পর মার হাত থেকে বাঁচানোর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিণতি থেকে তিনি কাউকেই বাঁচাতে পারেননি। না ইমনকে। না সুপ্রভাতকে। না নিজেকে। পুরো উপন্যাসে আমার মামা তথা জামিলুর রহমান এর চরিত্রটির জন্য সবচেয়ে বেশি মায়া লাগতো।
মিতু : বড় মামার বড় মেয়ে মিতু ইমনের কয়েক মাসের বড়। বাইরে কঠিন রুক্ষ আচরণ করা মেয়েটিকে সুপ্রভা খুব পছন্দ করত। ফুপুর পাগলামি, ভাইদের অপকর্ম, সুপ্রভার বোকামি কিংবা বাবার মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত জীবন তাকে না ভাবালেও ইমনকে নিয়ে ছিল তার যত মাথা ব্যথা। মিতু মেয়েটি সামনাসামনি নানান কটু কথা ইমনকে বলত। এমনকি এও বিশ্বাস করত যে ইমনের তাকে প্রয়োজন। অথচ সে নিজেকে কখনই বুঝতে দিত না তারই আসলে ইমনকে বেশি প্রয়োজন। সুন্দরী মিতু মুখে যতই ঠাটপাট কথা বলুক না কেন, ইমন এর জন্য, বাবার জন্য, কিংবা সুপ্রভাত জন্য তার ছিল অকৃত্রিম মায়া, ভালোবাসা, টান। পুরো উপন্যাসে সবচেয়ে শক্তিশালী নারী চরিত্র ছিল মিতু। যে মেয়েটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের জন্য হলেও ইমনকে রক্ষা করেছে। ইমনের জন্য ঢাল হয়ে ইমনের জীবনে থেকে গেছে।
ফাতেমা : মিতুর মা, ইমন-সুপ্রভার মামি ফাতেমা, জামিলুর রহমানের স্ত্রী। অনেক বোকা স্বভাবের এই মহিলা চিরকালই স্বামীর আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত ছিল। কিশোরী জীবনে স্বামীর ঘরে এসে শরীরের পাশাপাশি সংসারের স্থূলতায়, স্বামীর ব্যস্ত জীবনে সুখের ভাগ বসাতে পারেননি ফাতেমা। সেই কষ্ট থেকেও মাঝে মাঝে ইমন আর সুপ্রভার সাথে দুর্ব্যবহার করে থেমে যেতেন না। তাদের মা সুরাইয়াকেও কথা শুনাতেন। সুরাইয়া সেই সব এমনভাবে সহ্য করত যেন কোন কিছুই তার কানে পৌঁছায়নি। অথচ ভাইয়ের বউয়ের এমন দুর্ব্যবহার তাকে প্রায়শই উন্মাদ করে তুলতো। অপেক্ষা উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র না হলেও বিশেষ চরিত্র হিসেবে মামি ফাতেমা জীবনের সব দুর্দশা ও দুর্ভোগ গুলো ভোগ করেছেন দিনের পর দিন।
শোভন-টোকন : বড়লোক বাপের বখে যাওয়া জমজ দুই ভাই শৈশব থেকেই ডানপিটে স্বভাবের ছিল। বড় হয়ে তাদের এই কর্মকাণ্ড আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করে। জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কিছু মানুষ নোংরা আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবন পদ্ধতি অবলম্বন করে সবচেয়ে বিচ্ছিরি ভাবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বেঁচে থাকে। তাদের এমন অবনতির পেছনে পরিবারের হাত না থাকলেও থাকে বড় ধরনের অবহেলা কিংবা বেখেয়ালি মনোভাব। শোভন-টোকন আমাদের সমাজের সেই সব ছেলেদের প্রতিচ্ছবি ধারণ করে যারা বড় হয় কেবল খারাপ কাজ করার জন্য। পারিবারিক বন্ধন আলগা করে এরা যাযাবরের মতো জীবন যাপন করতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শোভন শান্তশিষ্ট্য ও সাহসী চরিত্র এবং টোকন চটপটে ও ভীত স্বভাবের। অপেক্ষা উপন্যাসে টোকনের খুব একটা ভূমিকা না থাকলেও ইমনের জীবনে শোভনের ভূমিকা ছিল বেশ খানিকটা। শোভন একমাত্র মানুষ যার গানের গলা শুনে ইমনের অন্তরের পাশাপাশি চক্ষুগুলো শীতল হয়ে যায়। ইমনের ধারণা শোভন নিজেও জানে না তার গানের গলা কতখানি ভালো!
নবনী : খুবই স্বল্প সময়ের জন্য আসা নবনী চরিত্রটি খুবই বিরক্তিকর ছিল আমার জন্য। কিছু মেয়ে আছে যারা কিশোরী জীবনেই বেশ উড়ু উড়ু মনের হয়। সুদর্শন গৃহশিক্ষকের প্রেমে পড়ে তার সাথে প্রেমিকার মতোই আচরণ করে। নবনী তাদেরই একজন। ইমন তার প্রাইভেট টিউটোরিয়াল। সপ্তাহে প্রায় তিন দিন মাসে চার হাজার টাকার বিনিময়ে ইমন যাকে পড়াতো। সেই নবনী নামের মেয়েটি পড়াশোনায় ভীষণ ফাঁকিবাজি করলেও ইমনের মন জয় করতে অনেক ছেলেমানুষি চেষ্টা চালায়। তাতেও বিশেষ কোন লাভ হয় না। ইমনের জীবনে মিতুর চেয়ে শক্তিশালী কোন নারী চরিত্র যে নেই এবং হবেও না এ কথা যদি নবনী জানতো তাহলে ইমনকে ইমপ্রেস করতে এমন উঠে পড়ে লাগত না।
মুন্নী : বড় মামার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ইমন তার মাকে নিয়ে যে বাড়িতে উঠেছিল। সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার দূর সম্পর্কে আত্মীয় মুন্নী। যার সাথে সুরাইয়া ইমনের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। মুন্নী নিজেও গুরুগম্ভীর সুদর্শন ইমনকে স্বামী রূপে কামনা করতো। কিন্তু ইমন যে তাকে স্ত্রী রুপে চায় না। সেটা ইমনের মুখে শুনে প্রচন্ড আঘাত পায় মেয়েটি। নবনীর মতো মুন্নীও স্বল্প সময়ের জন্য ইমনের জীবনে এসেছিল। অথচ মুন্নীর সবচেয়ে বেশি ভাব ছিল অসহায় মা, আধা পাগল সুরাইয়ার সাথে।
ইমনের দাদি : ছেলের বাড়িতে বেড়াতে আসো বৃদ্ধ মহিলা ফিরোজের আম্মা, সুরাইয়ার শাশুড়ি তার ছেলে ইমনকে খুবই মহাব্বত করত। গ্রামীণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত বৃদ্ধা শেষ বয়সে প্যারালাইজড হয়ে ইমনের শেষ দেখা কামনা করেন। ছেলের হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া, ছেলে বউয়ের পাগলামি, জীবনে দুর্বিষহ সহ সব কিছুই তাকে ভিতর থেকে আহত করে। মানুষের জীবনে এমন করুণ পরিণতি মনে করিয়ে দেয় যেখানে মৃত্যু নিশ্চিত, যেখানে ভালোবাসা অসীম, সেখানে অপেক্ষা অমলিন হয়ে আছে। অপেক্ষা করা ছাড়া যেন আর কোন গতি নেই।
প্রিয়_অংশ : পুরো উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি অংশই মন ছুঁয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও কিছু অংশ ছিল যেগুলো মনের জমিনে আঁচর কে/টে/ছে আক্রমণাত্মক বিড়ালের মত। সেই অংশ গুলো হলো____
প্রতিটা মানুষ কোন না কোন অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। অপেক্ষা শেষ হলে মানুষ মারা যায়।
মানুষের মূল্য খুবই সামান্য। দশ হাজার টাকা হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর পরেও সেই টাকা শোকে মানুষ কাতর হয়। মানুষ হারিয়ে গেলে বিশ দিন পরেই আমরা মোটামুটি ভাবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি।
শৈশবের কিছু কিছু ভয় মানুষের সঙ্গে থেকে যায়। মানুষের বয়স বাড়ে। শৈশবের অনেক কিছুই তাকে ছেড়ে যায় ___ ভয়টা ছাড়ে না।
বিলাই আর পুরুষ মানুষ এই দুই জাতের কোন বিশ্বাস নাই। দুইটাই ছোকছুকানি জাত।
কতদিন পরে ছোট চাচার চিঠি এসেছে! ইমনের খাম খুলতেও মায়া লাগছে। খাম খুললেই তো চিঠি শেষ। এর চেয়ে যতক্ষণ পারা যায় খাম নিয়ে বসে থাকা যাক। ছোট চাচাকে দেখতে ইচ্ছা করছে ইমনের। কেমন হয়েছেন ছোট চাচা।
জামিলুর রহমানের মন আরো খারাপ হল। কি বোকা মেয়ে! তিনি মিথ্যা কথা বলবেন শুনে সে আঁতকে উঠেছে। বোকা মেয়ে জানে না যে জগৎটাই মিথ্যার উপরে চলছে। সত্যি কথা এখন শুধু বলে পাগলেরা।
অভিমানী ছোট্ট মেয়েটি জানলও না ___ এই পৃথিবীতে তার জন্য কত ভালোবাসাই না জমা ছিল।
মৃত মানুষের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য।
মানুষ একটু আধটু বদলায়। সেই বদলানোটাও খুব ধীরে হয় বলে চোখে পড়ে না___।
বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার। হুট করে দিয়ে দিলেই হয় না। অনেক ভেবে চিন্তে দিতে হয়।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন।
মানুষ অদ্ভুত প্রাণী, কখন কোন নেশা ধরে যায় বলা কঠিন।
সুন্দরের প্রতি শুধু যে মানুষের আকর্ষণ তা না। কীট পতঙ্গের ও তীব্র আকর্ষণ।
মুক্তির আনন্দে মানুষ অনেক উদ্ভট কান্ড কারখানা করে। ফাঁকা চায়ের দোকান আর শ্মশান এক জিনিস।
জামিলুর রহমান একা বসে আছেন। তার দৃষ্টি শূন্যে। তবে তার বসে থাকার মধ্যে অপেক্ষার একটা ভঙ্গি আছে। সেই অপেক্ষা কিসের অপেক্ষা? মৃত্যুর? জন্মের পর থেকে মানুষ এই একটি জিনিসের অপেক্ষা করে। কিন্তু কখনো তা বুঝতে পারে না।
পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় জিনিসগুলো জন্য কিন্তু টাকা লাগে না। বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন ধর জোছনা, বর্ষার দিনের বৃষ্টি, মানুষের ভালোবাসা।
আমার এই পৃথিবী কখনো স্থির হয়ে থাকে না। সারাক্ষণ ঘুরছে। এই জন্য পৃথিবীর কোন কিছু স্থির থাকে না।
বাগান ভর্তি গোলাপ ফুলের দৃশ্যটি যেমন সুন্দর। মেয়ের চোখ ভর্তি জলের দৃশ্যটাও তেমনি সুন্দর। গোলাপের টব গুলো কেনার জন্য টাকা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু মেয়ের চোখের জলের অপূর্ব দৃশ্যটির জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।
হাসলে মেয়েদের যতটা সুন্দর লাগে। হাসি চেপে রাখলে তার চেয়ে দশ গুণ বেশি সুন্দর লাগে।
বোকা ছেলেরাই কাঁদে বুদ্ধিমানেরা কাঁদে না।কেউ কারো মত হতে পারে না। সবাই হয় তার নিজের মতো। তুমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার বাবার কিংবা চাচার মত হতে পারো না। সব মানুষই আলাদা।
এ শহরে আছে বিচিত্র ধরনের মানুষ। আর আছে তাদের বিচিত্র ধরনের অপেক্ষা।
জগতের কোন দুঃখই কম না। ছোট দুঃখ, বড় দুঃখ, সব দুঃখই সমান।
ব্যক্তিগত মতামত : মানুষের জীবন চক্রের শুরু এবং শেষ ধরা না গেলেও আমরা এটাকে জন্ম ও মৃত্যু দিয়ে আলাদা করি। যে কোন মানুষের জন্ম হলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। অন্য সব প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই। শুধু পার্থক্য এতোটুকুই যে অন্য সব প্রাণীরা মারা গেলে কিংবা হারিয়ে গেলে কেউ তাদের অপেক্ষা করে না। অথচ মানুষ হারিয়ে গেলে তার প্রিয় মানুষ চিরদিনই তার ফেরার অপেক্ষা করে। অপেক্ষা উপন্যাস টি তার নামের মাঝে পূর্ণ সার্থকতা পেয়েছে। এক কথায় অসাধারণ এই উপন্যাস টি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে গেছে কেবল অপেক্ষার গল্প বলতে বলতে। মা-ছেলের জীবনের কোন পর্যায়ে গিয়ে অপেক্ষার শেষ হয় কিংবা আদৌ শেষ হয় কিনা তা জানতে হলে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....