- বই : সংশয় দূর হোক
- লেখক : মো. মিকাইল আহমেদ
- প্রকাশনী : দুর্বার পাবলিকেশন্স
- বিষয় : ইসলামি আদর্শ ও মতবাদ
- পৃষ্ঠা : 332
মহান স্রষ্টা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, জলে-স্থলে, মহাকাশে কিংবা পাতালে এত এত সব রহমত, বরকত ও রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন যে, একজন মানুষের পক্ষে এর সব রহস্য ভেদ করা কোনোদিনই সম্ভব নয়। সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু আমরা চাক্ষুষ দেখি, এরচেয়ে ঢের বেশি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে যা আমরা দেখি না তার মধ্যে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত রয়েছে ওই নীল আকাশের মাঝে, যা কোনোরূপ খুঁটি ছাড়াই আমাদের মাথার ওপর এক সুরক্ষিত ছাদ হিসেবে অবস্থান করছে সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত রয়েছে পেরেকসদৃশ পাহাড়- পর্বতের মাঝে, যা জমিনের খুঁটি হিসেবে কাজ করে।
রহস্য রয়েছে পাতালের ওই মাটির মধ্যে, যার ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে প্রতিটি জীবজন্তু। আমাদের কোনোরূপ সুপারিশ ছাড়াই মহান স্রষ্টা, মহান প্রভু, মহান প্রকৌশলী এমন মজবুত গাঁথুনি দিয়েছেন যে, বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের পুরোনো পৃথিবী তার সমগ্র সৃষ্টিজগৎ নিয়ে মাটির নিচে ডেবে যায়নি কখনো। নিঃসন্দেহে এই মাটির মধ্যেই রয়েছে নিগূঢ় কোনো রহস্য, যা থেকে উৎপন্ন হয় মানুষের জন্য উপকারী ফুল, ফল ও নানাবিধ বৃক্ষরাজি। যে বৃক্ষ থেকে উৎপন্ন হয় জীবন বাঁচানো অক্সিজেন। অক্সিজেন ও পানি ছাড়া একটা মুহূর্তও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এ সকলই আল্লাহ অসীম কুদরতের মহিমা। এই মাটি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম ।
এ সমস্ত কিছুই সংঘটিত হয় একমাত্র আল্লাহর ইশারায়। আল্লাহ চোখ দিয়েছেন দেখার জন্য, কান দিয়েছেন শোনার জন্য, বোধশক্তি দিয়েছেন চিন্তা করার জন্য। চোখের জ্যোতি থাকা সত্ত্বেও অন্ধ সেজে বসে থাকা, শ্রবণশক্তি থাকা সত্ত্বেও বধির সাজা, কুরআনের মধুর সুরে অন্তরকে বিগলিত করতে না পারা, অন্তর থাকা সত্ত্বেও উপলব্ধি না করা, বোধশক্তি থাকা সত্ত্বেও বিচার-বিবেচনা না করা, সত্যের বাণী আসা সত্ত্বেও পাগলের প্রলাপ বকা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সংশয়বাদের কোনো স্থান নেই। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তই অনন্য। কাকডাকা ভোর থেকে হিমশীতল স্নিগ্ধ সকাল, ভরদুপুরের তপ্ত রোদ থেকে উদাসী বিকেল, সন্ধ্যার আকাশে সাঁঝবাতির ঝলক থেকে মধ্যরাতে চাঁদের জোছনা; কিংবা সারাদিনের হাড়ভাঙা বিরামহীন পরিশ্রমের পর ক্লান্ত মানবের জন্য প্রশান্তির ঘুম স্রষ্টার সৃষ্টি-কৌশলের অনুপম দক্ষতার জানান দেয়।
আমার বিশ্বাস, এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় পাঠকের হৃদয়ে দোলা দেবে। বিশ্বাসীর বিশ্বাসকে করবে দৃঢ়, বিশ্বাসের দেয়ালকে দেবে মজবুত গাঁথুনি। সংশয়বাদীদের সংশয়ের শ্যাওলাকে করবে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার। বিশ্বাসীর চিন্তাচেতনায় জন্ম নেবে হাজারো কৌতূহল। কারণ স্রষ্টা যেমন রহস্যময়, তেমনি তাঁর সৃষ্টিজগৎ। এক স্রষ্টার প্রতি নতি স্বীকারেই প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করবে প্রতিটি অন্তর। পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর অশেষ রহমতে ‘সংশয় দূর হোক’ বইটি লেখার কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি।
আলহামদুলিল্লাহ। অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বইটির প্রকাশক ও সম্পাদক মহোদয়কে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে বইটি আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। আরও ধন্যবাদ জানাই যারা আমাকে বইটি লেখায় উৎসাহ জুগিয়েছেন। বইটিকে ত্রুটিমুক্ত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও যদি কোনোরূপ ভুলত্রুটি থেকেই যায়, তাহলে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখার জন্য পাঠকের প্রতি বিনীত অনুরোধ রইল। - মো. মিকাইল আহমেদ।
আল কুরআন ঐশী গ্রন্থ
(Al Quran is the divine book)
এখন বেঁচে আছে, আর কয়েক মুহূর্ত পর বেঁচে থাকবে কি না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সাধ্য নেই পৃথিবীর কোনো মানুষের; হোক না সে মস্ত বড়ো পণ্ডিত, গবেষক, ডাক্তার কিংবা তুখোড় কোনো বিজ্ঞানী। মৃত্যুর ভয়াবহ বাস্তবতার কাছে হঠাৎ কোনো মুহূর্তে তাকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হতে পারে, ভোগবিলাসের মত্ততা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটতে হতে পারে অসীম জগতের দিকে। কিন্তু বড়ো বিস্ময়ের কথা, মানুষ তার এই ঠুনকো ক্ষমতা আর বিদ্যার দৌড় নিয়ে কীভাবে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাচ্ছে; বলে দিচ্ছে অবলীলায়, ‘এ তো মক্কার মুহাম্মাদের হাতে লেখা বানানো কিতাব!' নিঃসন্দেহে এর কারণ হচ্ছে, কুরআনের গভীরতা নিয়ে মানুষের ভাবনার সীমাবদ্ধতা। তার জ্ঞানের স্বল্প পরিসরে যখন কুরআনের অলৌকিক সত্যতার প্রমাণগুলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, বিস্ময়ে সে ফেটে পড়বে নিশ্চিত। তাই কুরআনের অজস্র সত্যতার প্রমাণ থেকে আমরা কয়েকটি নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রাখছি।
১. নবিজির সত্যতাই কুরআনের সত্যতা
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআনকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কুরআনকে প্রত্যাদেশরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি সে কুরআন মানবজাতিকে নিজ জবানিতে পড়ে শুনিয়েছেন। এখন যার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে কুরআন, তাঁর দাবিকে সত্য ধরে নিতে সর্বপ্রথম তাঁকে সত্য বলে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। কিন্তু তখনই কি আপনার দ্বিধা? আপনার কি মনে হচ্ছে এই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিথ্যা ঝুলি খুলে বসেছিলেন? তাহলে একবিংশ শতাব্দীর এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আপনি তাঁর মুখনিঃসৃত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো দেখুন। ভেবে দেখুন, কী অপার বিস্ময়ে চৌদ্দশত বছর আগের কথাগুলো বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে! যার ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত কথাগুলোকে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করে নিতে হচ্ছে, পূর্ব ঘটমান বিষয়ের সংবাদে তাঁকে অসত্য প্রমাণের সুযোগ আছে? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন—
দেখুন,
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَتَبَاهَى النَّاسُ فِي الْمَسَاجِدِ ‘যতক্ষণ পর্যন্ত লোকেরা মসজিদের (সৌন্দর্য ও সুসজ্জিতকরণ) নিয়ে পরস্পর গর্ব না করবে, ততক্ষণ কিয়ামত সংঘটিত হবে না।”১)
এখন কি তা-ই ঘটছে না? বর্তমান পৃথিবীতে আমরা কি চাক্ষুষ দেখছি না যে মসজিগুলো রকমফের টাইলস, এসি, নানা ধরনের ডেকোরেশনে সুসজ্জিত কিন্তু পর্যাপ্ত মুসল্লি নেই কিংবা মুসল্লি থাকলেও প্রকৃত মুসল্লির অভাব?
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যদিকে বলেছেন—
يأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانُ، لَا يُبَالِي المَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ، أَ مِنَ الحَلَالِ أَمْ مِنَ الحَرَامِ
‘মানুষের ওপর এমন একটি সময় আসবে, যখন কেউ ভ্রুক্ষেপ করবে না যে, সে যা গ্রহণ করেছে—তা হালালের অন্তর্ভুক্ত, না হারামের।'
বর্তমান পৃথিবীতে কি এটি খুব বাস্তব চিত্র নয় যে, মানুষ ন্যায়ের কথা ভুলে গিয়ে যে যেভাবে পারছে সম্পদ লুফে নিচ্ছে? কাড়ি কাড়ি অর্থের সন্ধানে বিসর্জন দিচ্ছে হালাল-হারামের মানদণ্ড? ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি সুদ তো মুসলিম কমিউনিটিতেও ছড়িয়ে পড়ছে এখন মহামারি আকারে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গিয়েছে এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া।
সেই দেড় হাজার বছর আগের এসব কথা বাস্তবে পরিণত হয়ে যাওয়ার একটিমাত্র দৃষ্টান্তই তো নবিজিকে সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য করে। অথচ শত- সহস্র এমন কথা তিনি বলে গিয়েছেন, যার অধিকাংশ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে আছে, আর কিছু আবশ্যিকভাবে প্রমাণিত হবে বলে অপেক্ষা করছে।
২. কুরআনের অলৌকিক বৈশিষ্ট্যাবলি
কুরআনকে যদি এর শব্দশৈলী ও অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যয়ন করা হয়, তখন নিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, এটি বিশ্বের অন্যান্য গ্রন্থাবলি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এতৎসত্ত্বেও কুরআন তার বিরুদ্ধতাকারী জাতিগোষ্ঠীসহ সমস্ত মানবজাতিকে কুরআন নাজিলের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত, এর অনুরূপ একটি সুরা কিংবা একটি আয়াত তৈরি করে দেখানোর জন্য চ্যালেঞ্জ করে গিয়েছে। মানবজাতি তখন থেকেই তার মতো একটি সুরা কিংবা একটি আয়াত তৈরি করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। দেখা গিয়েছে, একটু দুঃসাহস দেখিয়ে যারাই কুরআনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চেয়েছে, তারা সবাই নিজেকে উপহাসের পাত্র বানিয়ে শেষমেশ অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কুরআন তার অন্তর্গত নৈপুণ্য এভাবে জাহির করেছে, যেটা মানুষের সাধ্যের অতীত। কেননা, পুরো কুরআন অলৌকিক এমন কিছু বৈশিষ্ট্যে আবৃত, কোনো মানুষ হাজার প্রচেষ্টা করলেও নিজ থেকে সেটা করে দেখাতে পারবে না। যেমন :
• অলৌকিক শব্দ নির্বাচন
তুখোড় বাগ্মী, সাহিত্যিক কিংবা কবি যে-ই হোক না কেন, আজ অবধি কেউ স্বরচিত রচনার ব্যাপারে এ দাবি করতে পারেনি যে, তার রচনার শুরু থেকে শেষ, প্রত্যেকটি শব্দ সাহিত্যমানে সর্বোৎকৃষ্ট। কিন্তু কুরআন স্বগর্বে এই চ্যালেঞ্জ করে তৎকালীন আরব পৌত্তলিক কবি-সাহিত্যিকদের লা-জবাব করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। বলা হয়েছে তাদের—পারলে এমন শব্দ-বাক্য দিয়ে সামান্য কয়েকটা আয়াত তৈরি করে পেশ করতে, কিন্তু তারা সে দুঃসাহস দেখায়নি। যেমন : জাহিলি যুগে 'মৃত্যু' অর্থবোধক অন্তত বিশটিরও অধিক শব্দের প্রচলন ছিল। কিন্তু পৌত্তলিক ধারণা অনুসারে মৃত্যু যেহেতু একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া; আখিরাত কিংবা পরকাল বলতে কিছুই নেই, তাই তাদের মাঝে প্রচলিত সেই শব্দগুলোর সবগুলোর মধ্যেই এই ধারণার ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু কুরআন ‘মৃত্যু’ অর্থবোধক শব্দ নির্বাচনে এমন এক নৈপুণ্য দেখিয়েছে, যেখানে মিলেছে মৃত্যুপরবর্তী সময়ে পরকাল এবং স্থায়ী জীবনের ইঙ্গিত; সেইসাথে কুফ্ফারের ভ্রান্ত ধারণার প্রতি এক শক্ত চপেটাঘাত।
• অলৌকিক বাক্য গঠনের দৃষ্টান্ত
শব্দ নির্বাচনে কুরআনের অলৌকিকত্ব প্রকাশের পাশাপাশি বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও কুরআন দেখিয়ে দিয়েছে, এ রকম বাক্য একজন মানুষের পক্ষে বানানো মোটেই সম্ভব না। যেমন : তৎকালে হত্যার বিপরীতে হত্যার ধারণা তো খুবই প্রসিদ্ধ একটি বিষয় ছিল। কুরআন সেই বিধান আরও পোক্ত করে নিরূপণ করেছে। তখন এই বিধানের উপকারিতা বর্ণনায় কুরআন দেখিয়েছে, গতানুগতিক বাক্যের ভঙ্গিমা এড়িয়ে কী চমৎকার শৈলীসমৃদ্ধ উপস্থাপন সম্ভব। কুরআন বলছে—
وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴾ ‘হে বুদ্ধিমানেরা! কিসাসের ভেতর তোমাদের জন্য রয়েছে জীবন (রক্ষার ব্যবস্থা)। []
খেয়াল করে দেখুন, এখানে এমন বাক্য নির্বাচনের মাঝে কত আবেদন লুকিয়ে আছে! সংক্ষিপ্ত পরিসরে ব্যাপক অর্থবোধক একটি বার্তা দিয়ে দিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে কুরআন। অথচ 'কিসাসকে গুরুত্ব দাও', “কিসাস হত্যার প্রতিশোধে উত্তম প্রক্রিয়া', 'হত্যার বিনিময়ে হত্যাই জনজীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনবে', 'হত্যার শাস্তি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা'—এ জাতীয় বাক্যগুলোও কিন্তু জনমুখে তখন প্রচলিত এবং খুব সহজবোধ্যই ছিল। কিন্তু কুরআন তার স্বতন্ত্র শিল্পনৈপুণ্য দিয়ে বলছে, 'কিসাসের মধ্যেই তোমাদের জীবন।'
• উপস্থাপনের ধরনে অলৌকিকত্ব
কুরআন নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নানা ধরন ও নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে, যেসব মানবশক্তির সৃষ্টিশীলতার ঊর্ধ্বে। যেমন : কুরআন শরিফ আদতে কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়। কিন্তু যেহেতু মানুষ গদ্যের চেয়ে পদ্যে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে, তাই কুরআন শরিফ এমন এক অভিনব ভঙ্গিমায় নিজেকে উপস্থাপন করেছে, মৌলিকভাবে পদ্য না হলেও আয়াতের আড়ালে আড়ালে পদ্যের ঢং দেখে পাঠকের মন দুলে উঠতে বাধ্য হয়। সূক্ষ্ম অর্থবোধক আয়াতের সাথে সাথে দেখা যায় একেবারে হৃদয় তড়পে ওঠা সাবলীল উচ্চারণ; যেন-বা ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থের মধ্যে নানা ধরনের স্বাদ একসাথে জমা হয়ে গেছে।
• অলৌকিক ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্যতা রক্ষা
যেহেতু কুরআন মাজিদ নবুয়তের ২৩ বছরে ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হয়েছে, তাই অনেকেই স্বাভাবিকভাবেই বলবেন, কুরআনের আয়াতগুলোর মাঝে পারস্পরিক সামঞ্জস্য বিধান তালাশের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিটি আয়াতের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে এমন নিগূঢ় সামঞ্জ্যতা আছে, যেটা কোনো মানবের পক্ষে রক্ষা করা অসম্ভব। গভীর মনোযোগী তিলাওয়াতকারীমাত্রই এ ব্যাপারটি বুঝতে সক্ষম হবেন।
৩. বিজ্ঞানময় কুরআনের অলৌকিক পাঠ
সেই দেড় হাজার বছর আগের প্রেক্ষাপটে কুরআন কী অদ্ভুতভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিত্রায়ণ করে করে গিয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। আধুনিক বিজ্ঞান আজ যা বহু কষ্ট করে আবিষ্কারের চেষ্টায় আছে, কুরআন তা চোখে আঙুল দিয়ে দৃঢ়তার সাথে তখনই বলে গিয়েছে। কীভাবে সম্ভব হলো এসব? কখনো সমুদ্র ভ্রমণ না করেই কি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করলেন নবিজি সমুদ্রের তলদেশ? কোনো রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ব্যবহার কিংবা আলট্রাসনোগ্রাফি ছাড়াই ব্যাখ্যা করে দিলেন মায়ের গর্ভে শিশুর ধারাবাহিক অবস্থা? প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং সাধারণ বিধিবদ্ধ বিজ্ঞান এখনও যেখানে পৌঁছতে পারেনি, এমন সব বাস্তবতাও কুরআন সমাধান করে দিয়েছে সে সময়।
৪. কৃত ভবিষ্যদ্বাণীতে কুরআনের অলৌকিকত্ব
কুরআন গায়েবি সংবাদ এবং ভবিষ্যতে ঘটবে—এমন অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছে। বাস্তবেও সেসব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন অক্ষরে অক্ষরে দেখা গিয়েছে। যেমন : কুরআন ঘোষণা করেছে, রোম ও পারস্যের মধ্যকার যুদ্ধে প্রথমত পারস্যবাসী জয়লাভ করবে। পরবর্তী সময়ে কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর রোম পরাজিত করবে পারস্যকে। কুরআনের এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর তো মক্কার সরদাররা এ ভবিষ্যদ্বাণী অযথার্থ প্রমাণ করতে গিয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে বাজি পর্যন্ত ধরেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী রোম জয়লাভ করায় তারা কুরআনের বলিষ্ঠ উচ্চারণের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছিল।
৫. পূর্বে ঘটমান অজানা ঘটনার প্রকাশে কুরআনের অলৌকিকত্ব
আসমান কীভাবে সৃষ্টি হলো, কীভাবে সূচনা হলো মানবজাতির, অথবা অতিক্রান্ত হওয়া পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর বাস্তবিক চিত্র কেমন ছিল ইত্যাদি সম্পর্কে কুরআন এমন সব তথ্য দিয়েছে, যেসব ওহির সংযোগ ছাড়া জানা অসম্ভব।
৬. কুরআন তিলাওয়াতের রুহানিয়্যাত
কুরআন মাজিদ যতই পাঠ করা হোক না কেন, কোনো রকম বিরক্তি বা ক্লান্তির অনুভূতি আসে না। যত বেশি পাঠ করা যায়, ততই মধুময় মনে হয়; ততই বাড়তে থাকে আগ্রহ। পৃথিবীর যত ভালো ও আকর্ষণীয় পুস্তকই হোক না কেন, কখনো না কখনো তা বিরক্তির কারণ হয়েই পড়ে। কিন্তু কুরআন এখানে কতই-না অলৌকিক রুহানিয়্যাতে ভরপুর, বিস্ময়কর বটে। কুরআন নিজেই বলছে—
اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
“আল্লাহ নাজিল করেছেন উত্তম বাণীর এমন এক কিতাব, যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, যার বক্তব্যসমূহ পুনরাবৃত্তিকৃত। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।' [8]
৭. নির্ভুল, অবিকৃত ও সুসংরক্ষিত কিতাব
কুরআন শুধু ঘোষণাই করেনি যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন; বরং দেড় হাজার বছর ধরে তাকে সংরক্ষিত রেখে এর বাস্তবতা প্রমাণ করেছে। বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধন না হয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তা সংরক্ষিত থাকার চ্যালেঞ্জও কুরআন দিয়েছে। নাজিলের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনের প্রতিটি জের, জবর তথা স্বরচিহ্ন পর্যন্ত অবিকৃত রয়েছে। এই সংরক্ষণব্যবস্থায় নিয়োজিত থেকে প্রতি যুগেই যথেষ্ট কুরআনের হাফেজ ছিলেন এবং রয়েছেন। সংরক্ষণে এমন দৃঢ়তা পৃথিবীর কোনো ধর্মীয় কিতাবই দেখাতে পারেনি।
সুতরাং নিঃসন্দেহে এই ফলাফলে আমরা পৌঁছতে পারি যে, কুরআন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রেরিত ঐশী গ্রন্থ। এটা যে তাঁরই প্রেরিত গ্রন্থ, তা চিন্তাভাবনারও আছে আমাদের বিস্তৃত সুযোগ। ড. গ্যারি মিলার যেমন বলেছিলেন, ইসলাম কীভাবে মানুষকে কুরআনের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ দেয়, তার একটি নিখুঁত উদাহরণ সুরা নিসায় পাওয়া যায়।। আমি যখন প্রথম এই চ্যালেঞ্জটি আবিষ্কার করি, তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। এতে বলা হয়েছে—
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ
اخْتِلَافًا كَثِيرًا
তারা কি কুরআনকে বিবেচনা করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও পক্ষ থেকে হতো, তবে তারা অবশ্যই এতে অনেক অমিল পেত।
সংশয় দূর হোক বইটির অরিজিনাল কপি সংগ্রহ করুন -
ওয়াফিলাইফ | রকমারি | বইফেরী | বইপাও
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....