একটা জসীমউদ্দিন না থাকলে এই বাংলার কি হতো?
রবীন্দ্রনাথের অনুসারী এবং অনুকরণকারী কবি-সাহিত্যিক অজস্র, অগুণতি । নজরুলকে দেখেও কম সাহিত্যিক নকলের চেষ্টা করেননি। কিন্তু জসীমউদ্দিন, তাঁর পূর্বসূরী কোথায়? উত্তরসূরীই বা কই!
না, আমাদের সাহিত্যে এমন পল্লী গাঁয়ের কাদা-মাটি দিয়ে গড়া গেঁয়ো কবি একজনই। যার হাতে কলম ওঠা মানেই ছিল পল্লীমায়ের আনন্দ-বেদনার মর্মকথার অক্ষরে অক্ষরে ফুটে ওঠা । এমন মধুর করে গাঁয়ে বেড়োবার নিমন্ত্রণ কজন পারতেন দিতে? -
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়..
সাহিত্যিকদের চোখ তখনো সরেনি রাজনীতি-সমাজনীতি-শহর-সভ্যতা থেকে। এই সময়ে গ্রামীণ জীবনের কথা মনে করিয়ে দিতে হাজির হলেন জসীমউদ্দিন মোল্লা। একেবারে যুবক। একটা কবিতা লিখেছেন, 'কবর'। আর তাতেই নড়েচড়ে বসেছে গোটা সাহিত্যাঙ্গন। কি তার ভাষার গাঁথুনী, কি তার আবেদন, কি নিখুঁত মর্মবেদনা,
এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
.....................
ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিয়ে ঘন আবিরের রাগে,
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুরে,
মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দূরে।
জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান।
ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ।
নিজেই তখন কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়ের বিএ ক্লাসের ছাত্র। আর তাঁর এই কবিতা রীতিমতো মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে চলে এসেছে! এ ঘটনা বিশ্বের আর কোনো সাহিত্যিকের আছে কি না জানা নেই।
জসীমউদ্দিন যেন গ্রামবাংলার প্রত্যেকটা মানুষের নাড়ি বুঝতে পারতেন। গ্রামের কৃষক, বধূ ,মা,রাখাল,শিশু,ক্ষেত, বন,নদী, অনাহার, দারিদ্র্য, সুখ,হাসি,কান্না - সব কিছু দিয়ে তাঁর একটা অনবদ্য রূপকথা লিখতে সময় লাগতো না। গ্রামের এই পলিয়াপনাকে ভালোবেসে নকশী কাঁথার মাঠের "রূপাই" য়ের কালো রংয়ে তিনি মহিমান্বিত করেছেন এভাবে -
কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,
কালো দাঁতের কালি দিয়েই কেতাব কোরান লেখি
জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময়;
চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।
সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার’
রং পেলে ভাই গড়তে পারি রামধনুকের হার |
কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন,
তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন |
এ শুধু জসীমউদ্দিন বলেই সম্ভব।
পল্লীকবির যে দিকটা উপেক্ষিত, তা হচ্ছে তিনি তাঁর একক প্রচেষ্টায় লোকগানের এক বিশাল ভান্ডারকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে উঠে এনেছেন।
দেশে এমন মানুষ কি আছেন, তাঁর অন্তত একটি কবিতাও যার ঠোঁটস্থ নয়? সম্ভবত নেই।
যে ঘর ভেঙে যায়, তার ঘর বাঁধার প্রতিদান দিতে পারেন বলেই তিনি জসীমউদ্দিন,আমরা যাদের গেঁয়ো বলি, তাদের মধ্যে বাংলাকে খুঁজে পান বলেই তিনি বাংলা মায়ের যোগ্যতম সন্তান, বড় বড় সরকারি চাকরি ছেড়ে পাড়াগাঁয়ে এসে গান কুড়িয়ে বেড়াতে পারেন বলেই তিনি আমাদের পল্লিকবি।
শুভ জন্মদিন আমাদের গাঁয়ের সন্তান, বাংলার চিরায়ত রূপাই, প্রিয় জসীমউদ্দিন।
ছবি : একটি অনলাইন পত্রিকার বরাতে, ১৯৪০ সালে কবি। লেখাটি বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র গ্রুপেও পোস্ট করা হয়েছিল।
©শাফায়াত স্বচ্ছ
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....