আমরা আমাদের আশেপাশে সাধারণত দু-প্রকার ভালোবাসা দেখতে পাই: এক প্রকার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ; ততটুকু, যতটুকু মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব। আরেক প্রকার ভালোবাসায় স্বার্থের মিশ্রণ সুস্পষ্ট। প্রথম প্রকার ভালোবাসায় ব্যক্তি প্রিয়জনের জন্য তা-ই চায় যা প্রিয়জন চায়, যদিও এতে করে সে প্রিয় ব্যক্তিটির সংসর্গবঞ্চিত হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার ভালোবাসায় সে প্রিয়জনকে ধরে রাখার জন্য তাকে কষ্ট দিতেও পিছপা হয় না।
আজকাল দ্বিতীয় প্রকার ভালোবাসার দৌরাত্ম্য দেখে ভয় হয়, যদি এবিষয়ে কিছু বলি, মানুষ মনে করবে আমি পাষাণ-হৃদয়, ভালোবাসা কাকে বলে তার আমি কী জানি!
মৃত্যু একটি স্বাভাবিকতা। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যে পরিণত হয়। জীবনের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা পরবর্তী পর্যায়ে চলে যাই। সক্রেটিস বিষপানের সময় তাঁর শিষ্যদের কাঁদতে দেখে বলেন, ‘Death may be the greatest of all human blessings.’ মৃত্যুকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে একটিমাত্র ক্ষেত্রে আপত্তি থাকতে পারে: যদি কেউ মনে করি যে, এর পরে আর কিছু নেই।
পরিচিত মহলে বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম যে, বৃদ্ধ বাবা-মাকে মেশিন দিয়ে মাসের পর মাস vegetable state-এ রেখে দিয়ে তাদের নামমাত্র বাঁচিয়ে রাখা অন্যায়। তারা তাদের আয়ু পূর্ণ করেছেন এবং যখন তাদের চলে যাবার সময় হবে, তখন যেকোনো এক উসিলায় মৃত্যু তাঁদের সামনে উপস্থিত হবে। সেসময় চিকিৎসার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু কোনো চিকিৎসা নেই বলে মেশিন দিয়ে শুধু তাদের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখা তাদের প্রতি জুলুম।
আমি নিজেকে দিয়ে চিন্তা করি। আমার বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা যেদিন থেকে কাজ করবে না, সেদিন থেকে আমার বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমার শরীরটাকে যদি মেশিন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে আমার সন্তানেরা আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে মা আছেন বা আমরা টাকাপয়সার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না-করে মাকে বাঁচিয়ে রেখেছি—সেটা কি হাস্যকর হবে না? কী জানি, আমি এতে পরিতৃপ্ত হবার মতো কিছু দেখি না। শরীরটা আমার হতে পারে, কিন্তু আমি সেই শরীরের চেয়ে নিজেকে আরেকটু বেশি কিছু মনে করি। সেই বেশি কিছুর অস্তিত্ব যদি না-থাকে, তবে শুধু খোলটা জিইয়ে রাখা বোকামি নয় কি?
যাকে ভালোবাসি তাকে ধরে রাখার চেয়েও ছেড়ে দেয়া অনেক-সময় অনেক বড় ভালোবাসার দাবি। এটা বুঝতে পারলে হয়তো আমরা বাবা-মাকে মেশিন দিয়ে জিইয়ে না-রেখে তাদের জীবদ্দশায় তাদের সাথে সময় কাটানোর বা তাদের খুশি রাখার ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিতাম।
বই: ওপারে
লেখক: রেহনুমা বিনতে আনিস
অর্ডার লিংক [Click Here]
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....