রুচিবাগীশের ‘জাদুঘর’
জ্বালাময়ী ভাষণের সম্পৃক্ততা বজায় রাখা আগুনঝরানো কোনো বই─শেষ কবে পড়েছেন? যে বইয়ের পাতায় পাতায়─ঘুণাক্রান্ত সমাজের অপরিশোধিত আখ্যান এবং শত কিংবা সহস্রাধিক লাঞ্ছনা-ব্যঞ্জনা সহ্য করা একটি জাতির বেঁচে থাকার অমলিন সংগ্রামের গল্প লেখা রয়েছে? যদি মনে করতে না পারেন; তবে অসুবিধা নেই। লেখক কেপি ইমনের ‘জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে’ আপনার ভেতরে নিষ্ক্রিয় হওয়া অগ্নিকে আবারও উসকে দিতে এমন একটি বইয়ের রচনা করে বসেছেন।
রক্তের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে...
যদি ভাবেন শুধু রক্তের খেলা আর সংগ্রামের গল্প লিখতেই লেখকের কালঘাম বেরিয়ে একাকার অবস্থা হয়েছে─এমনটা নয়।
সমাদৃত শান্তিরক্ষা বাহিনির সুনামে আলোকিত অবয়বের বিপরীতে সবুজে ঘেরা রাজ্যের অন্তরালে পাশবিক উৎপীড়নে লুকানো গল্প─মিথ হয়েও তা যেন বহুলাংশে সত্য। লেখক এক শোষিত সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহকে আলোকিত করার সংকল্প নিয়ে─ঘুণেধরা এই সমাজের অরাজকতার যত আঁতুড়ঘর ভেঙে দিতে তৈরি করেছেন এমন একটি জাদুঘর।
এই জাদুঘরে পরিত্যক্ত কোনো স্মারক বা স্মৃতি সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত হয় না। হয়─সমাজের যত অনিয়ম, অসংগতি, অনাচার ও অপব্যবহার মেরামত করার কাজে। তবে কি জাদুঘর-এর পেছনে রয়েছে এমন কেউ─যে সর্বজনমান্য? যার অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসের প্রবলতা অন্য যে-কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে বহুগুণে কাম্য?
এই দেশে যেসব খবর নিয়ে কেউ কেউ মাথা ঘামায় আবার অনেকে ঘামায় না; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে─উপজাতিদের ওপর হামলা এবং এর পেছনে মূল হোতাদের কারসাজি। টুকরো টুকরো করে যে খবর এধার-ওধার ঘুরে বেড়ায়─তাতে চোখ বুলানোর বিশেষ প্রয়োজন কারও হয়তো পড়ে না; এমনকি তা জানতে আকর্ষণ বোধও জাগ্রত হয় না। কারণ, এই দেশে ‘ভাইরাল টপিকের’ ভাণ্ডার অফুরন্ত। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার এই দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা; একই ঘটনা যখন উপজাতিদের সাথে ঘটে─তা নিয়ে আন্দোলন বা সোচ্চার হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা খুব একটা প্রকটিত যেমন না; তেমন প্রসারিতও না। তারা যেন দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েও পরজীবংশ (পরজীবীর বংশ)। অথচ স্বাধীনতার কথা বললে, সবার সমান অধিকার রয়েছে এই দেশের প্রতি। কিন্তু বলির মঞ্চে, মাথা শুধু তাদেরই পেতে দিতে হয়। ─কেন?
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই দেশের হালহকিকতের অবস্থার উন্নতি কতটা হয়েছে; তা হাতে গুনে বলে দেওয়ার মতো। উন্নতি হয়েছে যতটা─অবনতি হয়েছে তার চেয়েও বেশি। সত্যের মৃত্যু না থাকলেও; এই দেশে সত্য নিয়ে কিছু বললে─তিরোহিতের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। যার বহু রূপ-কাণ্ড ইতোমধ্যে সমাজ স্বীকৃত।
বেশ গভীর আলোচনা মনে হলেও; জাদুঘর বইতে রয়েছে এরও অধিক কিছু। এই বইয়ের আলোচনা করতে বসলে প্রথমে যে বিষয়গুলো নিয়ে সবাই লিখবে বা লিখেছে তা হলো─দুটো সময়সারণির যুগপৎ মেলবন্ধনে প্রথম ও উত্তমপুরুষে বর্ণিত অতীত ও বর্তমানে স্রোতের বিপরীতে চলা কাহিনি। অথবা জাদুঘর নামক গুপ্তসংঘ─সমাজের কোন কোন বিষয়ে পরিবর্তনের সংকল্প নিয়ে কার্য সম্পাদন করে যাচ্ছে─তা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনার কথাও ক্লেশহীনতায় উঠে আসবে। চরিত্রায়ন এই উপন্যাসে অনবদ্য। মনস্তাত্ত্বিক বাক্যালাপ নিয়ে লিখতে গেলে—এই লেখা বৃহত্তর থেকে বৃহত্তম পর্যায়ে পৌঁছোবে।
রহস্য-রোমাঞ্চ জনরায় পাঠক যখন তীর্থের কাকের মতো কোনো প্রবল ধাক্কার আশায় বসে থাকে─তাদের চেহেরায় খুশি বজায় রাখতে লেখক সেই যজ্ঞেরও আয়োজন করে রেখেছেন। মনস্তাত্বিকের খেলা─এই উপন্যাসের শেষ খেলা হিসেবে বিবেচিত হবে; যা আগামীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তবে এই বই নিয়ে যে ব্যাপক মারামারি ও হানাহানির কথা প্রচলিত; তা কি অমূলক?
ক্লান্ত দেহে শ্রান্ত হওয়ার কোনো বাণী; লেখক অনুসরণ করেছেন কি-না জানা নেই। জাদুঘর উপন্যাস পড়তে গিয়ে অনুভব করেছি; এই বইয়ের আগাগোড়া ক্লান্তি-হীন এক লেখকের উজ্জীবিত হওয়ার বিরামহীন বাক্যের সমারোহে বেষ্টিত। যেখানে শব্দেরা টিন পরা চশমা ভাঙার আন্দোলনে নামে; বাক্যেরা রাজপথে একত্রিত হওয়ার কাব্য রচনা করে। সেই কাব্য রচয়িতা হচ্ছে উক্ত উপন্যাসের মূল নায়ক।
বাংলাদেশের অনিয়ম আর অবিচারের সমাজ বদলে দেওয়ার জন্য নানান মুনির আছে নানান মত। কেউ মনে করেন গণতন্ত্রের সঠিক প্রয়োগ জনগণকে এ-থেকে মুক্তি দেবে, কেউ ভাবেন ইসলামি প্রজাতন্ত্রই একমাত্র সমাধান। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছাত্র মনে করলো ভিন্ন কিছু। তাদের বিশ্বাস, নষ্ট হয়ে যাওয়া সিস্টেমকে একেবারে ধ্বংস করেই গড়ে তুলতে হয় নতুন কিছু। এই দুজন ছাত্রের একজন অর্ণব; আরেক জন ‘আমি’। কে এই আমি? এই আমি হতে পারে লেখক, এই আমি হতে পারেন আপনি অথবা এই আমি হয়তো আমি-ই। লেখক এই আমি’র একটা নাম দিয়েছেন; উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে যা উন্মোচিত হয়। তবে এই আমি’র সাথে যে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব─উপন্যাসের শুরু থেকে তৈরি হয়; তা একেবারে শেষ পর্যন্ত অবধারিত থাকে।
‘যম্মিন দেশে যদাচার’ প্রবাদের ব্যবহার জাদুঘর উপন্যাসে বেশ কয়েক বার করা হয়েছে। পুরো বইয়ের এই একটি প্রবাদ বাক্য নিয়ে কেন লিখতে বসলাম; তা আপনার ভাবনায় ঘাই নাও মারতে পারে। যা নিয়ে কোনো পাঠক কিছুই বলেনি তা হলো─লেখক যে বিষয় নিয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন; তার সাথে একমত কি-না। শুধু লেখা ভালো, চরিত্র গঠন দুর্দান্ত, দয়ামায়া-হীন শব্দ ও রাখঢাক ব্যতীত বাক্যের ব্যবহার নিয়ে প্রশংসার ফুল-বৃষ্টি করলেও; মতামতের একাত্মতা অথবা বিরোধিতা তেমন কাউকে করতে দেখলাম না।
শুধুমাত্র মনস্তাত্ত্বিক খেলা, নগ্ন সত্য উন্মোচন, অবহেলিত জীবন, ভালোবাসার কাঙালপনাকে বড়ো করে দেখানো এই উপন্যাসের একমাত্র উদ্দ্যেশ্য ছিল না। পুরো সমাজকে যদি বদলাতে হয়, সর্বপ্রথম প্রয়োজন─সংগ্রাম। সংগ্রাম হবে আর রক্ত ঝরবে না; তা কী করে হয়? তবে কি এই সংগ্রামে─নিরীহ মানুষের রক্তে রাঙানো মঞ্চের কোনো যৌক্তিকতা আছে? যুদ্ধ যে দেশে হোক না কেন; নিরীহ মানুষের বলিদান সেখানে অনস্বীকার্য। এই সত্য লুকানো না। বরং এটাই বাস্তবতা। বাস্তবতার প্রত্যকটি বিন্দু জাদুঘর উপন্যাসে নিহিত।
যে দেশে আমাদের বসবাস তাও রক্ত দিয়ে অর্জিত। আগামীতে কোনো সংগ্রামের আয়োজন হলে─রক্ত দিয়ে সেই মঞ্চের ক্যানভাস রাঙানো হবে। কোনো আন্দোলনের ডাক দেওয়ার বিপরীত অর্থ—রক্ত ঝরানো। হোক সেটা শহরে, গ্রামে অথবা কোনো পাহাড়িয়া স্থানে। অদ্ভুত ভাবে এই উপন্যাসে শহরের বাতাবরণ যেমন রয়েছে; তেমন পার্বত্য অঞ্চলে ঘটে যাওয়া নানান রোমহর্ষক ঘটনার আবির্ভাব হয়েছে। দুটো গল্প পৃথক্কৃত হলেও সামঞ্জস্যতা নির্ণীত।
জাদুঘর কি সব পাঠকের পড়ার উপযোগী বই?
যেসব পাঠক উদারনীতিক সমীকরণে বিশ্বাসী─তাদের জন্য জাদুঘর অবশ্যই পাঠ্য। তবে রাষ্ট্রের তিক্ত সত্য ধারণ না করতে পারা স্তাবক এবং সুশীল ধারায় বিশ্বাসি পাঠকগণ─উক্ত বইয়ের সামীপ্যে না থাকায় উত্তম। তবে, একটা কথা─‘আস্কে আমার মন ভালো নেই’-এর মতো বলব না। বলব─প্রত্যেক রুচিবাগীশের এই উপন্যাস পড়া প্রয়োজন। সমালোচনা করার জন্য হোক অথবা যুক্তিতর্ক দিয়ে বাক-বিতন্ডা করার প্রয়াসে; এই বইয়ের স্বাদ নেওয়া উচিত বলে মনে করি।
জাদুঘর শুধু দেশের সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ডামডোলে সীমাবদ্ধ থেকেছে─এমনও না। এই বইয়ের কালো অধ্যায়গুলোতে সংগ্রামের কথা থাকলে, গভীর আলাপনে ভালোবাসার সাথে মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধের ভিন্ন রূপের অবতারণা ঘটেছে। যেমন─
❝চেহেরা বা মাসলের সাথে একটা মানুষ দশ ঘণ্টা বসে থাকতে পারে না। তাকে বসতে হয় মানুষটার মস্তিষ্কের সাথে। এই মস্তিষ্কটা যদি গাধা হয়ে থাকে, তাহলে তার সাথে দীর্ঘ সময় বসে থাকা যায় না।❞
মানসিক শান্তি-অশান্তির অনেক ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সরব উপস্থিতি যে একমাত্র কাম্য──তা ঘটা করে বলে দিতে হয় না। এই নিয়ে উপন্যাসে আরও যৌক্তিক কিছু আলোচনা রয়েছে। জাদুঘর যতটা গল্প নির্ভর ঠিক ততটাই সংলাপ নির্ভর। কঠিন সব সংলাপ। শক্ত কাঠির খোঁচা খেলে অনুভূতি যেমন চাগিয়ে ওঠে, সংলাপ পড়লে আপনার অবস্থা ঠিক তেমনই হবে। কঠিন সংলাপের উদাহরণ টেনেছি ভিন্ন একটি কারণে। কথায় কথায় গালি দেওয়া যে বাঙালিদের অতি প্রিয়─তা যেন আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পেরেছি উক্ত উপন্যাস পড়ে। শুধু এই একটি জায়গায় আরেকটু প্রভেদের প্রয়োজন ছিল।
আলোচিত হোক বা সমালোচিত; সিনেমার মারামারি হোক বা বইয়ের─এই নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন মনে হয়। তবে এমন অভাবনীয় কিছু বইয়ের পাতায় থাকলে মানসনেত্র দেখতে বড়ো ভালো লাগে। সহিংসতা─সমর্থন করার মতো কোনো বিষয় না হলেও; সহিংসতা ছাড়া সবকিছু যেন অপূর্ণ। জাদুঘরে যদি এমন সহিংসতা না থাকত; তবে তা অপূর্ণ থেকে যেত। তাই নয় কি?
সাদৃশ্যতা নিয়ে সমালোচনা কেন হলো?
‘কিরি’ নাম ‘ডেথ নোটের’ ‘কিরা’ থেকে এসেছে; গল্পের সমাপ্তি ‘ফাইট ক্লাব’-এর মতো মনে হয়েছে। এমন ধারণা না আমার জন্মেছে না মনে একবার হলেও উঁকি দিয়েছে। অথচ ডেথ নোট আর ফাইট ক্লাব দুটোই আমার দেখা। একটি বই পড়তে বসলে; যাবতীয় সব চিন্তাভাবনা এক পাশে রেখে পড়া উত্তম। নাহয় এমন অনেক কিছু মনে হতে পারে। আর যদি কিয়দংশ মিলকরণ থাকে; তবে তা কাকতালীয় মানতে আমার নারাজ না কেন? বারবার অনুপ্রাণিত বা নকলের মতো কীওয়ার্ড ব্যবহার করতে হয় কেন?
প্রাচীন কালে যুদ্ধের হাতিয়ার ছিল─তীর, ধনুক আর তলোয়ার। আর বর্তমানে গোপনাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র-সহ যাবতীয় অত্যাধুনিক যুদ্ধ সামগ্রী। উক্ত উপন্যাসে এই অস্ত্র ব্যবহারের নৈপুণ্যতা লক্ষণীয়। যদি এই বইয়ের সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করতে হয় তবে─প্রত্যকটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যাবে। সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। কিন্তু কোনো পাঠকের যদি এই বই নিয়ে বিশদ আলোচনা করার খায়েশ জাগে; তবে তাঁকে স্বাগত।
বইয়ের সম্পাদনা প্রসঙ্গে আসলে, খুব বেশি ত্রুটি চোখে না ধরা পড়লেও বানানের কারণে অসুবিধা ভালোই হয়েছে। পরবর্তী সংস্করণে এমন ত্রুটিবিচ্যুতি কমিয়ে নিয়ে আসা ভালো। জাদুঘর সিরিজের দ্বিতীয় বইয়ের প্রচ্ছদের সাথে প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তন করাতে ভালো হয়েছে। যদিও এখন এসব প্রচ্ছদ, বাঁধাই জ্বালাতন করে না। কিন্তু ভেতরের সম্পাদনা আর বানান পরিমার্জিত থাকা প্রয়োজন।
উক্ত বইয়ের বিষয়বস্তু এতই বেশি যে, আলোচনার জন্য বিশালাকার যযাতির প্রয়োজন। যারা সিরিজটি পড়তে আগ্রহী বা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন; তাদের উদ্দেশ্যে বলব—যত দ্রুত সম্ভব শুরু করেন। মৌলিক নন-ফিকশনের সমম্বয়ে এমন ফিকশনমূলক সাহসী কাজ একমাত্র কেপি ইমন দ্বারা সম্ভব।
বইটি বাতিঘর প্রকাশনী থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন বাপ্পী খান। মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা মাত্র।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....